ওয়াসার এমডির নিয়োগ বাণিজ্য, বিদেশে পাচার শত কোটি টাকা

আপডেট: ৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ১০:০০ পূর্বাহ্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক | গত ১৫ বছর ধরে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এ কে এম ফজলুল্লাহ। এই সময়ের মধ্যে তার দায়িত্বের সাতবারের মেয়াদ শেষ হলেও অষ্টমবারের মত নিয়োগ পেয়েছেন। এতবছর ধরে ওয়াসার গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করলেও নগরবাসীর পানি সংকটের সমাধান করতে পারেননি তিনি। উল্টো বেড়েছে ওয়াসার পানির দাম।

৮১ বছর বয়সী এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উঠেছে নানা অভিযোগ। প্রায় ৫শ’ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করে পকেটে পুরেছেন ১০০ কোটিরও বেশি টাকা। অভিযোগ আছে—অবৈধ কামাইয়ের বেশির ভাগ অর্থ পাচার করেছেন বিদেশেও। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক মন্ত্রীর আত্মীয়-স্বজনকে কোটি কোটি টাকার কাজ পাইয়ে দিয়েছেন এই কর্মকর্তা।

এদিকে, সম্প্রতি তার এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য চিঠি আকারে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে পাঠিয়েছেন চট্টগ্রাম ওয়াসার সিবিএ’র সাবেক সভাপতি নুরুল ইসলাম।

অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেছেন—এ কে এম ফজলুল্লাহ ওয়াসার আলোচিত কর্মকর্তা। তাঁর আমলে পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পাঁচটি বড় প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে কোনো প্রকল্পের কাজই নির্ধারিত মেয়াদে শেষ হয়নি। বায়ও বাড়াতে হয়েছে তিনটির। নগরে পানির সংকটও কাটেনি। সংকটের মধ্যেও পানির দাম বেড়েছে ১২ বার। বছর পাঁচেক আগে এ কে এম ফজলুল্লাহ ঘোষণা নিয়েছিলেন, ২০২০ সালের মধ্যে চট্টগ্রামবাসী দিন-রাত ২৪ ঘন্টা নিরাপদ পানি পাবেন। ওই ঘোষণা আলোর মুখ দেখেনি। এখনো প্রতিদিন ঘাটতি রয়েছে ১২ থেকে ১৫ কোটি লিটার পানির।

এছাড়াও, প্রকৌশলী ফজলুল্লাহ চট্টগ্রাম ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী থাকা অবস্থায় কর্তব্যে অবহেলার জন্য বরখাস্ত হন। চট্টগ্রাম ওয়াসা থেকে অবসর নিয়ে তিনি সোশ্যাল সেভিংস এন্ড কো অপারেটিভ ক্রেডিট লিমিটেড নামক একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হন। সাধারণ গ্রাহকদের কোট কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ১/১১ এর সময় তিনি গ্রেপ্তারও হন দুইবার। সেসময় তিনি জেলও খাটেন। সাধারণ মানুষের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় এখনও ৬টি মামলা রয়েছে।

অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। যা কৌশলে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছেন তিনি। চট্টগ্রাম ওয়াসায় কর্মরত দেশি-বিদেশি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান থেকে ৫ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশ ঘুষ নিয়ে আমেরিকা ও মালয়েশিয়ায় পাচার করেছেন এমডি ফজলুল্লাহ।

এদিকে গত এক যুগে ওয়াসার এই এমডি কর্মকর্তা-কর্মচারি নিয়োগ দিয়েছেন প্রায় ৫শ’ জন। এতে লেনদেন হয়েছে প্রায় ১শ’ কোটি টাকা। যার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ওয়াসা শ্রমিক লীগের সভাপতি তাজুল ইসলাম। এই নিয়োগে ওয়াসার এমডি ফজলুল্লাহর ভাগনা-ভাগনি ও ব্যক্তিগত ড্রাইভারও রয়েছেন। এছাড়া, জাপানী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে গাড়ি উপঢৌকন নিয়ে তা বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি।

উল্লেখ্য, এ কে এম ফজলুল্লাহ ওয়াসার আলোচিত কর্মকর্তা। তার আমলে পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পাচটি বড় প্রকল্প নেওয়া হয়। তার মধ্যে কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প (প্রথম পর্যায়), কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়), চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন ও পয়োনিষ্কাশন প্রকল্প ও ভান্ডালজুড়ি পানি সরবরাহ প্রকল্পসহ চার প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। কোনোটিই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। উল্টো দুটিতে ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। এদিকে, তার দায়িত্ব পালনের মেয়াদে নগরে পানির সংকটও কাটেনি।

২০০০ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে অবসর নেন এ কে এম ফজলুল্লাহ। ২০০৯ সালের ৬ জুলাই প্রথমবার চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে এক বছরের জন্য নিয়োগ পান। এরপর আরও এক বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১১ সালে ঢাকা ওয়াসার আদলে চট্টগ্রাম ওয়াসাতেও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ তৈরি করা হয়। ওয়াসা বোর্ডও পুনর্গঠন করা হয়। তখন এমডি পদে নিয়োগ পান তৎকালীন চেয়ারম্যান এ কে এম ফজলুল্লাহ। সেই থেকে এমডি পদে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

চট্টগ্রাম ওয়াসা পরিচালিত হয় ১৯৯৬ সালের ওয়াসা অ্যাক্ট অনুযায়ী। এই আইনে সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এমডি। আইনে এমডি পদে একই ব্যক্তি সর্বোচ্চ কতবার বা কত বছর নিয়োগ পেতে পারেন, সে বিষয়ে কিছু বলা নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এমডি পদে নিয়োগ দেয় সরকার।

অভিযোগের বিষয় নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘যিনি আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ দিয়েছেন, তাকে বলেন এর সত্যতা কি? সংশ্লিষ্ট সংস্থা এই বিষয়ে তদন্ত করলে তো বুঝতে পারবে। আমার দীর্ঘদিন কাজ করছি সবাই আমার সম্পর্কে ভাল ধারণা রয়েছে। এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।’

সিএস

Print This Post Print This Post