পুলিশ চলে গেলে বন্দুকের গুলি ছুঁড়ে উল্লাস করেন ইউপি সদস্য ইউনুছ

আপডেট: ১৬ অগাস্ট ২০২০ ১০:৫৯ পূর্বাহ্ন

বাঁশখালী প্রতিনিধি | আপডেট : ১৬ আগস্ট, ২০২০ রবিবার ১০:৩০ এএম

চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার অত্যন্ত দুর্গম একটি এলাকা ছনুয়া ইউনিয়ন। উপকূলীয় এলাকা এবং রাস্তাঘাট খারাপ হওয়ায় দেদারসে অপকর্ম চালাচ্ছে ৮ মামলার আসামি ছনুয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান মো. ইউনুছ (৪৫) ওরফে ইউনুছ ডাকাত। এদের রয়েছে একটি ১২ জনের সংঘবদ্ধ চক্র।

এ ওয়ার্ডের জলকদর খালের পাশে অবস্থিত মধুখালী গ্রামের সাধারণ মানুষদের অভিযোগ- ইউনুছ ডাকাত ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় সাধারণ মানুষ রয়েছে আতঙ্কের মধ্যে। ইউনুছ মেম্বার এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন দিবারাত্রী। অব্যাহত রেখেছেন তার সন্ত্রাসী কার্যক্রম। উপকূলীয় এলাকা ও রাস্তাঘাট খারাপ হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়িও যেতে পারে না ইউনুছ ডাকাতের এলাকায়। সেই সুবাদে ইউনুছ কোন মাথাব্যথা ছাড়াই সাধারণ মানুষকে জুলুম করে যাচ্ছেন দেদারসে।

তার অপরকর্মের প্রতিবাদ করলে নির্যাতনের পাশাপাশি প্রতিবাদকারীকে অস্ত্র ও ইয়াবা ট্যাবলেট দিয়ে ছবি তুলে ইউনুছের মোবাইলে জমা রাখা হয়। ভুক্তভোগী থানায় গিয়ে আইনের আশ্রয় চাইলে ইউনুছ ডাকাত ছবিগুলো ইন্টারনেটে ভাইরাল করে দেন।

এই এলাকার অধিকাংশ মানুষের পেশা লবণ চাষ ও সমুদ্রে মাছ ধরা। দরিদ্র জনগোষ্ঠী নিয়েই গ্রামের মানুষের বসবাস। মাছ বা লবণ বেচা টাকা দেখলেই ইউনুছ বাহিনীর সদস্যরা বন্দুকের গুলি ছুঁড়ে সিংহভাগ কেড়ে নেয়। প্রতিবাদ করলে ধরে নিয়ে গিয়ে রাতভর মারধর করে। ইয়াবা ও বন্দুক দিয়ে ছবি তুলে মোবাইলে জমা রাখে। এসব পুলিশকে দিয়ে শায়েস্তা করার ভয় দেখায়। আত্মীয়স্বজন গিয়ে ক্ষমা চাইলে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে ছাড়ে। গ্রামবাসীদের বিচারের প্রত্যাশা যেন নিভৃতে কাঁদে। কোন ঘটনা ঘটলে থানা থেকে পুলিশ যেতে অন্তত দুই ঘণ্টা সময় লাগে। তাই সন্ত্রাসীদের আধিপত্যই হচ্ছে প্রধান।

এমনকি ইউনুছের পার্শ্ববর্তী ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নুরুল আবছার সিকদারও প্রশাসনকে নানাভাবে অভিযোগ করেও ইউনুছ বাহিনীর সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে গ্রামবাসীকে রক্ষা করতে পারেননি।

ইউনুছের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন ইউসুফ নবী। ইউসুফ নবীসহ ইউনুছ বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের বিরুদ্ধে রয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।

২০১৮ সালে ছনুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. হারুনুর রশিদ চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার সময় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বও দিয়েছেন অভিযুক্ত ইউপি সদস্য মো. ইউনুছকে।

ইউনুছ ডাকাত ২০১১ সালে ছনুয়া ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার নির্বাচিত হন। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ এপ্রিল ২য় বারের মত মেম্বার নির্বাচিত হলে তার সন্ত্রাসী কার্যক্রম দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়।

আরও পড়ুন:, বাঁশখালীর হারুন চেয়ারম্যানের অত্যাচারে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বাঁশখালী ও চকরিয়া থানায় পলাতক ইউপি সদস্য মো. ইউনুছের বিরুদ্ধে ১৯৯৯ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত হত্যা, ডাকাতি, নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, অস্ত্র আইন, মাদক আইন, সন্ত্রাসী ঘটনাসহ অন্তত ৮টি মামলা রয়েছে। ৫টি মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও আছে তার বিরুদ্ধে।

অসংখ্য ঘটনার নির্যাতিতরা ভয়ে মামলা করেনি। বহু মামলার আসামি হলেও গত ২০১১ সাল থেকে তিনি ইউপি সদস্যের দায়িত্ব পালন করছেন। দুইবার মেম্বার নির্বাচিত হয়েছেন ঠিকই। কিন্তু একদিনের জন্যও ইউনিয়ন পরিষদে যেতে পারেননি এই সন্ত্রাসী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মধুখালী আমজাদিয়া এজহারুল উলুম বালক-বালিকা মাদরাসার এক ছাত্র বলেন, ‘আমাদের মাদরাসার দক্ষিণে ইউনুছ মেম্বার মাইক টাঙ্গিয়ে রাত-দিন আঞ্চলিক গান বাজনা করে। এতে আমাদের কোরআন পড়তে সমস্যা হয়। কিন্তু আমরা ভয়ে মুখ খুলতে পারি না।’

গত ২রা আগস্ট চাঁদা আদায় না করায় ইভটিজিংয়ের শিকার জয়তুন নাহার জ্যোতি (২৮) নামে এক গৃহবধূ বাঁশখালী থানায় ইউপি সদস্য মো. ইউনুছের বিরুদ্ধে অভিযোগও করেন।

এ ব্যাপারে গৃহবধূ জয়তুন নাহার জ্যোতি বলেন, ’আমার স্বামী মো. ফোরকান জাতিসংঘ শান্তি রক্ষীতে চাকরি করার সুবাদে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে আছেন। ওনাকে ইমোতে ফোন করে ইউনুছ ডাকাত ১০ লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা না দিলে ফোরকানের পৈতৃক বসতভিটা দিয়ে দিতে বলেন। আর এতে ফোরকান অপারগতা প্রকাশ করলে আমাকে বাড়িতে এসে ইউনুছ হেনস্তা করেন। তাই আমি বাধ্য হয়ে আইনের আশ্রয় নিলাম।’

গত ৩রা আগস্ট ওই অভিযোগের তদন্ত করতে যান বাঁশখালী থানার এসআই মো. হাবিবুর রহমানসহ কয়েকজন পুলিশ। এসআই মো. হাবিবুর রহমান তাৎক্ষণিক কয়েকজনের জবানবন্দি রেকর্ড করেন।

ওই সময় স্থানীয়রা অনেকে অভিযোগ করে বলেন, পুলিশকে অনেকবার অভিযোগ করেছি কাজের কাজ কিছুই হয় না। টাকা হারাচ্ছি আর মার খাচ্ছি। আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। পুলিশ চলে গেলে সন্ত্রাসী ইউনুছ মেম্বার বন্দুক দিয়ে প্রকাশ্যে গুলি ছুঁড়ে উল্লাস করে আর ভয় দেখায়। পুরো দক্ষিণ ছনুয়া জুড়ে প্রকাশ্যে দীর্ঘদিন ধরে লুটপাট চালাচ্ছে ইউনুছ মেম্বার। কেউ কিছু করতে গেলে তাকে চাঁদা দিতে হয়। কোন পেশার মানুষ তার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান মো. ইউনুছ বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে ঠিক। দুই একটি মামলার, বহু মামলার নয়। তবে আমি সন্ত্রাসী নই। আমি প্যানেল চেয়ারম্যান। তাই পুরো ইউনিয়নই আমার। অপরাধীদের ও আত্মীয় স্বজনদের অপরাধ স্বীকারের নানা বক্তব্য ও ছবি মোবাইলে রেকর্ড আছে। চাইলে তাদের ক্ষতি করতে পারি কিন্তু নিরীহ মানুষ বলে করি না। চেয়ারম্যান আমার জনসেবায় মুগ্ধ হয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়েছেন এবং প্রশাসনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।’

বাঁশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. রেজাউল করিম মজুমদার বলেন, ‘ছনুয়া ২ নম্বর ওয়ার্ড খুবই দুর্গম এলাকা। ইউপি সদস্য মো. ইউনুছের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে ঠিক। তার বিরুদ্ধে কয়টি মামলা রয়েছে সেটা এখন আমার নলেজে নেই। কয়টি মামলা আছে সেটা আমি দেখছি। তাকে গ্রেপ্তার করতে গেলে সে পালিয়ে যায়। মধুখালী আজিজুর রহমান পাড়া এলাকার এক গৃহবধূ ইউনুছ মেম্বারের নির্যাতনের ব্যাপারে অভিযোগ করেছে। পুলিশ তা তদন্ত করছে।’

সিটিজিসান ডটকম/আরএইচ/এমইউ

Print This Post Print This Post