
নিজস্ব প্রতিবেদক | আপডেট : ২৯ নভেম্বর, ২০২২ মঙ্গলবার : ১১.১৬ পিএম
বাঁশখালী পৌরসভার জঙ্গল জলদি মৌজার ১নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত বিএস ৭১ দাগের আন্দর ২ একর ৭৪ শতক জায়গার ওপর ১০ টি পরিবারের বসবাস। ১৯৯১ সালের মহাপ্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে সর্বস্ব হারিয়ে বাঁশখালীর উপকূলীয় এলাকার ১০টি পরিবার জঙ্গল জলদি পাহাড়ি এলাকায় এসে বসতি স্থাপন করে। এদের মধ্যে কেউ প্রতিবন্ধী, কেউ বিধবা আবার কেউ খেটে খাওয়া দিনমজুর।
গত ২০ নভেম্বর ভূমিহীন এই ১০ পরিবারের বসতঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় বাঁশখালী উপজেলা প্রশাসন। গুঁড়িয়ে দেওয়া স্থাপনার মধ্যে একটি মাদরাসা ও এবাদতখানা রয়েছে। কেটে ফেলা হয়েছে সহস্রাধিক ফলজ ও বনজ বৃক্ষ। মূহুর্তেই সবুজ গাছগাছালির আমিরাঘোনা এলাকা পরিণত হলো বিরানভূমিতে। প্রশাসনের দাবি, সেখানে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৫০টি ঘর নির্মাণ করা হবে।
সোমবার (২৮ নভেম্বর) দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, স্ক্যাভেটর দিয়ে গাছের গুঁড়ি উপড়ে ফেলে ধ্বংসাবশেষ মুছে দেওয়া হচ্ছে। আশেপাশের আরও কয়েক পরিবারকে নোটিশ দিয়েছে গাছ কেটে ফেলার জন্য। এসব পরিবারের সদস্যরা গাছ কাটার কাজে ব্যস্ত। টানটান উত্তেজনার মধ্যে সকালে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে টাঙানো হয়েছে সাইনবোর্ড।
স্থানীয়রা জানান, রবিবার (২০ নভেম্বর) থেকে দফায় দফায় চালানো হয়েছে উচ্ছেদ কার্যক্রম। এখনো চলছে বৃক্ষ নিধন ও ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার মহোৎসব। এতে অংশ নিয়েছেন খোদ উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সার্ভেয়ার গোলাম মাওলাসহ কয়েকশত স্থানীয় সন্ত্রাসী। বর্তমানে কেটে ফেলা গাছের শিকড় ও গোড়ালি বুলডোজার দিয়ে উপড়ে ফেলা হচ্ছে। লোকজনকে সরে যেতে হুমকি দেয়া হচ্ছে। নুরুল আলম নামে আরেক ভূমিদস্যু গতকাল সেখানে জায়গার দখল বুঝে নিতে মহড়া দিয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় যুবলীগ নেতা সাঈদসহ একটি সিন্ডিকেটকে জায়গা পাইয়ে দিতেই প্রশাসনের নেতৃত্বে এই উচ্ছেদ কার্যক্রম চালানো হয়েছে। বর্তমানে সন্ত্রাসীদের ভয়ে চরম আতংকে দিন কাটাচ্ছে বাঁশখালী পৌরসভার ৫নম্বর ওয়ার্ডের আমিরাঘোনা এলাকার বাসিন্দারা। তাছাড়া ভূমিহীনদের ওই জায়গায় সরকারী উপহার ঘর নির্মাণ প্রকল্পের জায়গা বলে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ বর্তমানে নতুন করে বাঁশখালীতে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর দেয়ার এই প্রকল্প আসেনি বলে জানা গেছে। সরকার উপহারের ঘর দিলে আরেকজন ভূমিহীনকে উচ্ছেদ করে ঘর বাড়ি ভেঙে কিংবা গাছপালা কেটে তান্ডব চালিয়ে কোন ধরনের উপহার দেবে সেটাই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের প্রশ্ন। তাছাড়া বর্তমানে উচ্ছেদ করা বসতবাড়িতে অন্ধ, প্রতিবন্ধি ও পঙ্গু মানুষও রয়েছে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে যুবলীগ নেতা মো. সাঈদ বলেন, ‘প্রশাসনের লোকজন লেবার নিয়ে গেছে উচ্ছেদ করার জন্য। আমি উচ্ছেদ করার জন্য যাইনি। সেদিন সাংবাদিক ও পুলিশ ছিল ঘটনাস্থলে। ওখানে তো আমার কিছু নেই। আমি কেন সেখানে হেল্প করবো? প্রশাসনের পক্ষ থেকে লাল পতাকা টাঙানো হয়েছে।’
বাঁশখালীর গণ্ডামারা ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনা, সরল ইউনিয়নের মিনজীরিতলাসহ বিভিন্ন এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর লোকজন কম মুল্যে জায়গা কিনে পৌরসভার পাহাড়ি ওই এলাকায় বসতি স্থাপন করেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ফরিদা আক্তার বলেন, ‘সরকারী খাস জায়গা লিজ নিয়ে দীর্ঘ ৭০ বছরেরও বেশী সময় ধরে পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসছি। বর্তমানে সেখানে কয়েক শত বসতবাড়ি রয়েছে। কিন্তু জায়গা জমির মুল্য বেড়ে যাওয়ায় খেটে খাওয়া মানুষের ওই জায়গার উপর ভূমিদস্যুদের কু-নজর পড়ে। তারা এর আগেও কয়েক একর এরিয়ার বিশাল এই জায়গা দখলে নিয়ে নানা অপতৎরতা চালায়। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর দেয়ার নামে ওই জায়গা দখলে নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তুলে গরীব লোকজনকে প্রথমে হুমকি ধমকি পরে প্রশাসনকে হাত করে তাদের উচ্ছেদ করেন। আমাদেরকে ঘর দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়েছে। এখন আমি বৃদ্ধ বয়সে যাবো কোথায়?’
আরেক ভুক্তভোগী সাংবাদিক শফকত হোসাইন চাটগামী বলেন, ‘সরকার আমাকে ২০১০ সালে ভূমিহীন সনদ দিয়েছে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে সবকিছু হারিয়ে জঙ্গল জলদি এলাকায় বসতি স্থাপন করি। এখন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমি মুখ খুলতেছি। এসিল্যান্ড আমাকে চুপ থাকতে বলেছেন এবং ঘর দেবেন বলেছেন। আমাদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।’
বাঁশখালীতে প্রশাসনের এমন তান্ডবের ঘটনায় সর্বত্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর প্রদান নিয়েও। সরকার খেটে খাওয়া ভূমিহীন মানুষের জন্য এই প্রকল্প চালু করলেও বাঁশখালীতে গরীব মেরে বড় লোকদের জায়গা দখল করার এই ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাঁশখালী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) খন্দকার মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘ওখানে ৪ থেকে ৫টি অবৈধ বসতি ছিল। এরমধ্যে ২টি জুয়ার ঘর। এগুলো উচ্ছেদ করা হয়েছে। আর যে ৫-৭ জনকে উচ্ছেদ করা হয়েছে ; তাদেরকে সরকারি ঘর দেওয়া হবে। এটা তো মুজিববর্ষের প্রকল্প। এটা কি আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রকল্প? আমরা কেন জায়গা দখল করবো আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে দেওয়ার জন্য? আমরা তো ওখানে সাইনবোর্ড টাঙিয়েছি। ওখানে ৫০টি ঘর নির্মাণের জন্য একাউন্টে টাকা চলে আসছে। ওখানে বসবাসকারীরা এখন টিনের ঘরে রয়েছে। আমরা বলেছি তাদেরকে পাঁকা ঘর দেব। আর যে নুরানি মাদরাসা ও এবাদতখানা রয়েছে ;সেগুলো আগে মুরগীর খামার ছিল। আমরা নোটিশ দেওয়ার পর মুরগীর খামারটি নুরানি মাদরাসায় রুপান্তর করছে দখল করার জন্য।’
