
নিজস্ব প্রতিবেদক | চট্টগ্রামের বাকলিয়া থানার রাজাখালী বাংলাদেশ টিম্বার ডিপোতে সম্প্রতি ঘটে ডাকাতির ঘটনা। আর সেই ঘটনায় করা মামলায় প্রধান আসামি করা হয় পুলিশের খাতায় চিহ্নিত চাঁদাবাজ হিসেবে নাম লেখানো পরিবহন নেতা জানে আলমকে। জানে আলম এবং তার সহযোগীদের গ্রেপ্তারে পুলিশ অভিযানে গেলে স্থানীয় হিসেবে পুলিশকে ‘সাহায্য করার অপরাধে’ আবুল বশর নামে এক শ্রমিককে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে জানে আলম গ্যাং। কিন্তু ঘটনার পর থেকে টানা ৯ দিন থানার দ্বারে দ্বারে ঘুরেও মামলা করতে পারেনি ওই শ্রমিকের অসহায় পরিবার।
হামলার শিকার আবুল বশর বাকলিয়া থানার নতুন ব্রিজ এলাকার আব্দু সোবাহানের বাড়ির সোবাহান কলোনির মৃত আব্দুল মজিদ বলির পুত্র। অভিযুক্ত জানে আলম চন্দনাইশের পশ্চিম কেশুয়া ১ নম্বর ওয়ার্ডের ছোরত আলীর বাড়ির মৃত গুরা মিয়ার ছেলে।
ভুক্তভোগী পরিবারটির দাবি- অভিযানে গিয়ে পুলিশ জানে আলমকে ধরতে না পারলেও আটক করে তার কয়েকজন সহযোগীদের। আর সেই অভিযানে পুলিশকে সাহায্য করার ‘অপরাধে’ জানে আলম গং পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেয় পরিবহন শ্রমিক আবুল বশরের। আর ওসির সাথে জানে আলমের ‘বিশেষ সখ্যতা’ থাকায় ঘটনার ৯ দিন পরেও মামলা নিচ্ছে না পুলিশ। জানে আলমের নাম বাদ দিলেই মামলা নেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে তাদের।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জানে আলমের বিরুদ্ধে নগরীর কোতোয়ালী, বাকলিয়া ও জেলার চন্দনাইশ থানায় রয়েছে একাধিক মামলা। এসব মামলায় তিনি পুলিশ এবং ডিবির হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছেন কয়েকবার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম অটোটেম্পু শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. জানে আলম। বন্দরনগরীতে প্রবেশের দ্বার শাহ আমানত সেতুর বশিরুজ্জামান চত্বরের সড়ক দখল করে তিনি বানিয়েছেন ম্যাক্সিমা অটো টেম্পোর স্ট্যান্ড। চাঁদাবাজি, মাদকের কারবার, দখলবাজি থেকে ডাকাতি- সবকিছুতেই যেন সিদ্ধহস্ত তিনি।
মোটা অংকের চাঁদাবাজি করার জন্যই নতুন ব্রিজ থেকে টাইগারপাস রোডে টেম্পো চলাচলের রুট পারমিট দেওয়া হয়েছে। ‘চট্টগ্রাম অটো টেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন’ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে টেম্পো চালক-মালিকদের কাছ থেকে মাসে ২৫ লাখ টাকার বেশি চাঁদাবাজি করা হয়। ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জানে আলমের নেতৃত্বে এই চাঁদাবাজি চলে। কেউ টাকা দিতে অস্বীকার করলে বা হিসাব চাইলে তার উপর লাঠি-সোটা নিয়ে হামলা করে জানে আলমের লোকজন।
জানে আলমের মারধরের শিকার আবুল বশরের বড় বোন রোজি আক্তার বলেন, ‘জানে আলম ও তার গ্যাং সদস্যদের ধরতে পুলিশকে সহযোগীতা করায় আবুল বশরের ওপর ক্ষিপ্ত হয় সে। আমার ভাইকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়। গত ২৫ অক্টোবর দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে অস্ত্রসস্ত্রসহ জানে আলমের নেতৃত্বে একাধিক লোকজন নতুন ব্রিজের একটি চায়ের দোকান থেকে আমার ভাইকে তুলে নিয়ে যায় জানে আলমের অফিসে। এরপর আমার ভাইকে কিরিচ দিয়ে কোপানো হয় বাঁ হাতে। এরপর জানে আলমের সাথে থাকা অন্যান্যরা আমার ভাইকে লোহার রড দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে তার পা ভেঙে দেয়।’
তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় কোনো মামলা করলে আমাদের পরিবারসহ প্রাণে মারার হুমকি দেয় জানে আলম। কিন্তু আমরা থানায় এজাহার লিখে নিয়ে গিয়ে মামলার আর্জি জানালেও ঘটনার ৯ দিনেও মামলা নিচ্ছে না পুলিশ। এই ৯ দিনে সকাল-বিকাল-রাত তিন বেলা করে আমাদের থানায় নিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। শুধু সময়ক্ষেপণ করছেন ওসি। কারন ওসির সাথে জানে আলমের সখ্যতা আছে। আজকেও (রবিবার) আমাকে সকালে সময় দিয়েছিলো। বলেছে মামলা নেওয়া হবে। কিন্তু দুপুর পর্যন্ত বসিয়ে রেখে থানার সেকেন্ড অফিসার আমাকে উদ্দেশ্য করে, ‘বোঝেন না মামলা কেন নেয়া হচ্ছে না? ঠিক আছে রাতে আবার আসেন’। আমি মহিলা মানুষ। আমাকে দিনের পর দিন থানার দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দিতে হচ্ছে। এখনো মামলাই করতে পারছি না, বিচার পাবো কিনা তা আল্লাহ ভালো জানেন।’
রোজি আক্তার পুলিশের অভিযোগ করে বলেন, ‘পুলিশের কথা হচ্ছে জানে আলমের নাম এজাহার থেকে বাদ দিলে সাথে সাথেই মামলা নেবে তারা। কিন্তু আমি বুঝি না আমি প্রধান আসামিকে কেন বাদ দিবো? তাকে বাদ দিয়ে মামলা কেন করবো? জানে আলমই তো ঘটনার মূলহোতা। তার নাম বাদ দিতে কেন পুলিশের তোরজোড়?’
এজাহারে আসামিদের তথ্যে গড়মিলের কারণে মামলা গ্রহণ করা হচ্ছে না জানিয়ে বাকলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুর রহিম বলেন, ‘তারা প্রথমেই মিথ্যা কথা বলেছে। যখন ঘটনা ঘটেছে তখন আমি নিজেই হামলার শিকার ব্যক্তির (আবুল বশর) বড় বোন রোজিকে ফোন দিয়েছি। পরে তারা ৫ দিন পরে তার বড় বোন এবং জেঠি থানায় এসেছে। তারা এজাহারে আসামির নাম দিয়েছে ১৫ না ২০ জনের। কারও স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে উনি এলাকার অনেককেই আসামি করে ফেলছে। আমি বলেছি তাদেরকে, অসুবিধে নাই। আমি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবো।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে একটা কথা এসেছে যে আসামিকে ধরিয়ে দেওয়ার অপরাধে মারধর করা হয়েছে। আসলে মানুষ কেন যে এত মিথ্যা বলে আমি বুঝি না। আমি যতুটুকু বুঝি বা জানি, আসামি ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মারলে আমরা পুলিশ কি তাকে ছেড়ে দেব নাকি? আমাদের এখানে একটি মামলা হয়েছিলো। সেই মামলার আসামি ধরতে গেছে আমাদের অফিসার।’
ওসি বলেন, ‘এই লোকে (নুরুল বশর) নাকি যাদেরকে ধরছে তাদের মারধর করছে আবার মোবাইলও ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। এইরকম অভিযোগ আছে আর কি। আজ সকালে আসছিলো, আমি বলেছি রাতে আসতে। প্রয়োজনে কারেকশন করে মামলা নিয়ে নেবো।’
উল্লেখ্য, গত ১১ এপ্রিলও নতুন ব্রিজ এলাকা থেকে ডাকাতি মামলায় মো. জানে আলমকে গ্রেপ্তার করে নগর গোয়েন্দা (উত্তর) পুলিশ। এছাড়াও চাঁদাবাজির অভিযোগে এই জানে আলমকে একাধিকবার গ্রেপ্তার করেছে বাকলিয়া থানা পুলিশ। প্রত্যেকবারই সে জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও বুক উঁচিয়ে এলাকায় অপকর্ম করে বেড়ায়।
সিএস
