নিজস্ব প্রতিবেদক | আপডেট : ০৮ ডিসেম্বর, ২০২২ বৃহস্পতিবার : ৭.৩৫ এএম
রাঙামাটির শুকুরছড়ি ও ত্রিদিব নগরে প্রায় আড়াই’শ উপজাতি পরিবারের মধ্যে উচ্ছেদ আতংক বিরাজ করছে। গত কয়েকমাস ধরে চরম আংকে দিনাতিপাত করছেন দুই পাড়ার বাসিন্দারা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৬ কিলোমিটার দূরের রাঙামাটি পৌরসভার ময়লার ডাম্পিং উপ-প্রকল্পের জন্য ভূমি কেনা হয়েছে এই দুই পাড়ার মধ্যে। পৌরসভার বর্জ্য এখানে ডাম্পিং করা হলে পাড়ার বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা বিভিষিকাময় করে তুলবে। ধ্বংস হয়ে যাবে এলাকার মানুষের দৈনিন্দন জীবনের ব্যবহারের পানির উৎস। বন্ধ হয়ে যাবে পাহাড় স্কুল, প্যাগোডাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান।
স্থানীয়রা জানান, তাদের এই ভূমিতে ময়লার ডাম্পিং উপ-প্রকল্প না করার জন্য ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্থানীয় এমপি, জেলা প্রশাসক, পৌরসভার মেয়রকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। তবে কোথাও থেকে তাদের এই আবেদনে সাড়া মিলেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘শুকুরছড়ির ত্রিদিব নগরে রাঙামাটি পৌরসভার ময়লার ডাম্পিং উপ-প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের ফাইলপত্র আমি এখানে যোগদানের আগ থেকেই বিষয়টি প্রসেজ করা। আমি আসার পর প্রশাসনিক নিয়মে তা অগ্রগতি করেছি। এরমধ্যে ডাম্পিং স্টেশন সেখানে না করার দাবি জানিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা একটি আবেদন দিয়েছে। সেটা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই আবেদন পেয়ে মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধি দল ডাম্পিং স্টেশন উপ প্রকল্পের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করেছে। তারা জানিয়েছে এখানে ময়লার ডাম্পিং স্টেশন হলে স্থানীয়দের জীবন-জীবিকা বা পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না।,
জানা যায়, রাঙামাটির নানিয়ারচর ও সদর উপজেলার সীমানা এলাকার শুকুরছড়ি মৌজার ত্রিদিব নগরে দুইটি উপজাতি পাড়ায় প্রায় আড়াই শ ক্ষুদ-নৃগোষ্ঠি পরিবার বংশ পরস্পরায় বসবাস করছেন। এরমধ্যে একটি পাড়া শুকরছড়ির ১নং ওয়ার্ডে ও অপরটি ৬নং ওয়ার্ডে। সেখানকার একটি পাড়া থেকে অপর পাড়ার দূরত্ব মাত্র দুই শ গজের ব্যবধান। এরমধ্যে রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়ক। এবার সেই দুই পাড়ার মধ্যেই রাঙামাটি পৌরসভার ময়লা ডাস্পিং উপ-প্রকল্পের জন্য চার একর পাহাড় ক্রয় (অধিগ্রহণ) করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য জরিপসহ প্রয়োজনীয় কার্যাদি সম্পন্ন করেছে জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা। কয়েকদিনের মধ্যে ভূমি মালিককে ক্ষতিপূরণ বাবদ মূল্য পরিশোধ করে জমি ও জমির দলিলপত্র পৌরসভাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার তোড়জোর প্রস্তুতি চলছে। এরপরই শুরু হবে ডাম্পিং স্টেশন স্থাপনের পরবর্তি কার্যক্রম।
স্থানীয়দের ভাষ্য, এই দুই পাড়ার আড়াই শ পরিবারের বাসিন্দাদের দৈনন্দিন ব্যবহার ও খাওয়ার বিশুদ্ধ পানির উৎস এখানকার ঝিরি ও খাল। ঝিরির মধ্যে পাতকূয়া স্থাপন করে নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করে তারা।
তবে এখানে ময়লা ডাম্পিং করা হলে পাহাড় কেটে সাবাড় করে ফেলা হবে। নষ্ট হয়ে যাবে এলাকার আবহওয়া ও জীববৈচিত্র্য। ধ্বংস হয়ে যাবে পার্শ্ববর্তী সব ঝিরি ও খাল। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও ইউনিসেফ পরিচালিত পাড়া কেন্দ্র, স্কুল, ধর্মীয় উপাসনালয় ও বাজার কিছুসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কিছু থাকছে না।
তাদের ভাষ্য, এখানে যে শুধু ডাম্পিং স্টেশন স্থাপন করা হচ্ছে তা নয়, এই পাড়ার বাসিন্দাদের উচ্ছেদের নীল নকশা আঁকা হয়েছে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।
স্থানীয় বৃদ্ধ মায়াবতি চাকমা বলেন, ‘এখন কোথায় যাবো? আমাদের যাওয়ার তো আর কোনো জায়গা নাই। আর এই বৃদ্ধ বয়সে অন্য কোথাও গিয়ে আশ্রয় নেওয়াটাও শরীরে কুলাবে না। এখানে ময়লা ফেলা হলে ঝিরি-খালের সব পানি, পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে। দুর্গন্ধে এলাকায় আর থাকা যাবে না। পাহাড় গাছ তরুলতা কিছু থাকবে না। আমরা বাঁচবো কি নিয়ে, কিভাবে?’ এমন প্রশ্ন ৭৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ মায়াবতির।
স্থানীয় ৬ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ৬০ বছরের বৃদ্ধ জোহন চাকমা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ‘আমরা বংশ পরস্পরায় এখানেই বসবাস করছি। আর কোথাও কোনো কিছু আমাদের নেই। এখন আমাদের পৌরসভার ময়লা চাপা দিয়ে মারতে চায়।’
ত্রিদিব নগর এলাকার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ১ নং ওয়ার্ডের মেম্বার সুনিল কুমার চাকমা জানান, রাঙামাটি পৌরসভার ময়লা ডাম্পিং করার জন্য শুকুরছড়িতে পাহাড় কেনার খবর পেরেই আমরা প্রধানমন্ত্রী, স্থানীয় এমপি, জেলা প্রশাসক, পৌরসভার মেয়রসহ বিভিন্ন স্থানে পাড়াবাসির গণ স্বাক্ষরসহ আবেদন করেছি। পাড়ার বাসিন্দারা একজোট হয়ে কয়েকবার মানববন্ধন করেছে এখানে ময়লা ডাম্পিং স্টেশন না করার জন্য। তার পরেও কাউকে ভাবতে দেখিনি, এখানকার বাসিসন্দাদের জীবন-জীবিকা ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে। মনে হয়, এখানে একটা ডাম্পিং স্টেশন করা গেলেই সহজে পাড়ার বাসিন্দাদের তাড়িয়ে দেওয়া যাবে। এমনটাই ভাবছে সবাই।
একই ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের মেম্বার সুবেশ চাকমা জানান, এই এলাকায় প্রতি একর তৃতীয় শ্রেণির ভূমি এক লাখ বিশ থেকে দেড় লাখ টাকা। অর্থাৎ চার একর ভূমি কেনা যায় সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকায়। কিন্তু রাঙামাটি পৌরসভা থেকে এখানে এসে সেই চার একর পাহাড় কেনা হয়েছে চার কোটি ৩৭ লক্ষ ৩০ হাজার ২৪৫ টাকায়। রাষ্ট্রের অর্থ আত্মসাতে সংঘবব্ধ হয়ে এখানে এসে এই পাহাড়কে বেছে নেওয়া হয়েছে বলে তিনি ধারণা করছেন।
এই বিষয়ে রাঙামাটির পৌর কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য মেলেনি। পৌরসভার মেয়র মো. আকবর হোসেন চৌধুরীর বক্তব্য জানতে তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। তার মুঠোফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার এল এ মামলা নম্বর ০১ (ডি)/২০২১-২০২২ (১১০) এর দলিলপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, জেলার ১১০ নং শুকুরছড়ি মৌজার ত্রিদিব নগরের ৪৪/২১৫ নং হোল্ডিংয়ে পাঁচ একর পাহাড় রয়েছে মৃত ডা. ধর্ম জ্যোতি চাকমার ছেলে অনির্বান চাকমার নামে। এই পাঁচ একর পাহাড়ের মধ্যে চার একর পাহাড় পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন উপ-প্রকল্প স্থাপনে অধিগ্রহণের জন্য রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের নিকট আবেদন করেন রাঙামাটি পৌরসভার মেয়র মো. আকবর হোসেন চৌধুরী।
পরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এস.এ শাখায় দায়িত্বরত কানুনগো অরুন চন্দ্র তালুকদার ও সার্ভেয়ার কাজী ফরিদ উদ্দীন সরেজমিন পরিদর্শন করে ভূমি রেকর্ড প্রতিবেদন দায়ের করেন। এতে কানুনগো অরুন চন্দ্র তালুকদার ও সার্ভেয়ার কাজী ফরিদ উদ্দীন ওই ভূমির চৌহদ্দিতে উল্লেখ করেন, উত্তরে ঝিরি ও খাস পাহাড়, দক্ষিণে রাঙ্গাপানিছড়া তথা পাহাড়, পূর্বে নিখিল দেওয়ানের পাহাড়, আর পশ্চিমে সরকারি রাস্তা। বিস্তৃর্ণ এই পাহাড়ের মধ্যভাগে অনির্বান চাকমার পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া ব্যক্তিমালিকানাধিন জমি। তার পাঁচ একর পাহাড়ের মধ্যে চার একর পাহাড়কে দ্বিতীয় শ্রেণি দেখিয়ে রেকর্ডভূক্ত করেন এস.এ শাখার কানুনগো ও সার্ভেয়ারসহ সংঘবব্ধ চক্র।
রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এস এ শাখার বড় বাবু হিসেবে পরিচিত মায়াদেবী চাকমা জানান, পাহাড়ে ভূমির মূল্য নির্ধারণ করেন এসএ শাখার সার্ভেয়ার ও কানুনগোরা। সরকারিভাবে এখানে ভূমির নির্ধারিত কোনো মূল্য নেই।
অভিযোগ রয়েছে, রাঙামাটি পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন উপ-প্রকল্প স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণের খবর আগেভাগে জেনে যান পৌরসভার একটি চক্র। এরপরই পৌরসভা থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরের শুকুরছড়ির ত্রিদিব নগরের অনির্বান চাকমার কাছ থেকে তৃতীয় শ্রেণির পাহাড়ি চার একর ভূমি ১০ লক্ষ টাকায় কিনে নেয় তারা। পরে মন্ত্রণালয় থেকে ময়লা ডাম্পিংয়ের ভূমি ক্রয়ের অনুমতিপত্র পাওয়ার পরপই সেই পাহাড় চার কোটি ৩৭ লক্ষ ৩০ হাজার ২৪৫ টাকা মূল্যে পৌরসভাকে গছিয়ে দেওয়া হয়। আর এতে চার কোটি ২২ লক্ষ টাকার বেশি রাস্ট্রীয় অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বন্দোবস্তি সম্পন্ন করে সংঘবব্ধ চক্রটি।
Print This Post