রাঙামাটি পৌরসভার ময়লা ডাম্পিং উপ-প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে ‘নয়ছয়’

আপডেট: ৭ ডিসেম্বর ২০২২ ৮:৫৬ পূর্বাহ্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক | আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর, ২০২২ বুধবার : ৮.৫৬ এএম

রাঙামাটির নানিয়ারচরের সীমান্ত এলাকা শুকুরছড়ি ত্রিদিব নগরে চার একর জমির মূল্য সর্বোচ্চ ১০ লক্ষ টাকা। কিন্তু সেখানে রাঙামাটি পৌরসভা ময়লা ডাম্পিং প্রকল্পের জন্য চার কোটি ৩৭ লক্ষ ৩০ হাজার ২৪৫ টাকায় ক্রয় করেছে চার একর তৃতীয় শ্রেণির জমি।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এই প্রকল্পে রাষ্ট্রের চার কোটিরও বেশি অর্থ অপব্যবহার করা হয়েছে। এই নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সচেতন নাগরিক সমাজ। ফের এই পাহাড়টি কেটে সমতল করে ময়লা ফেলার উপযোগি করতে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয়ের আশংকা করছেন তারা।

তবে এই বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ রাঙামাটির পৌর কর্তৃপক্ষ। পৌরসভার মেয়র মো. আকবর হোসেন চৌধুরীর বক্তব্য জানতে তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি বক্তব্যের জন্য পৌরসভায় গেলেও তিনি ব্যস্ততার অজুহাতে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

রাঙামাটি পৌরসভার প্যানেল মেয়র জামাল উদ্দিন বলেন, ময়লা ডাম্পিংয়ের জন্য ভূমি ক্রয় করা হয়েছে শুনেছি। তবে এই বিষয়ে বিস্তারিত মেয়র সাহেবই ভালো বলতে পারবেন। আমাদের এই বিষয়ে তেমন কিছু জানা নেই। একই কথা বলেন পৌর কাউন্সিলর আকবর হোসেন।

স্থানীয় ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, রাঙামাটির নানিয়ারাচর ও সদর উপজেলার সীমানা এলাকার শুকুরছড়ি মৌজায় ত্রিদিব নগরে সচরাচর প্রথম শ্রেণির (সমতল চাষাবাদ যোগ্য ভূমি) প্রতি একর ভূমি বেচাঁ-কেনা হয় ৫ থেকে ৬ লক্ষ টাকায়। আর দ্বিতীয় শ্রেণি (সামান্য উচু-নীটু ঢালু পাহাড়) ভূমি দুই থেকে সর্বোচ্চ আড়াই লক্ষ টাকায়। প্রতি একর তৃতীয় শ্রেণির ভূমি (খাড়া উচু পাহাড়) এক থেকে একলক্ষ ২০ হাজার টাকায় মেলে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, তৃতীয় শ্রেণির চার একর পাহাড়ি ভূমি কাগজে কলমে হয়ে গেছে দ্বিতীয় শ্রেণি। আর সেই পাহাড় চার কোটি ৩৭ লক্ষ ৩০ হাজার ২৪৫ টাকায় অধিগ্রহণ (ক্রয়) করা হয়েছে রাঙামাটি পৌরসভার ময়লা ডাম্পিং স্টেশন স্থাপনে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, হেডম্যান, কারবারি ও সাধারণ অধিবাসিরা ধারণা করছেন, হয়তো পাহাড়টি সোনায় মোড়ানো। যার কারণে রাঙামাটি পৌরসভা থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে এমন পাহাড়ি ভূমি এতদামে কিনে নিয়েছে রাঙামাটি পৌর কর্তৃপক্ষ।

ত্রিদিব নগর এলাকার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ১ নং ওয়ার্ডের মেম্বার সুনিল কুমার চাকমা ও ৬ নং ওয়ার্ডের সুবেশ চাকমা জানান, এই এলাকায় প্রতি একর ভূমি দুই লাখ টাকা করে হলেও চার একর জমির মূল্য আট লাখ টাকা। এরসাথে লতাপাতা আর ঝোপজঙ্গল হিসেব করা হলে তা নয় থেকে দশ লাখ টাকায় পৌঁছতে পারে। সরকারি ২০০ শতাংশ হিসাবে ক্ষতিপূরণ যোগ করলে তা হয় সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা। তবে সেই পাহাড় চার কোটি ৩৭ লক্ষ ৩০ হাজার ২৪৫ টাকা দামে ক্রয়ের আড়ালে সরকারি বিপুল পরিমাণ অর্থ অপব্যবহারের ছক দেখতে পাচ্ছেন বলে তিনি জানান।

রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার এল এ মামলা নম্বর ০১ (ডি)/২০২১-২০২২ (১১০) এর দলিলপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, জেলার ১১০ নং শুকুরছড়ি মৌজার ত্রিদিব নগরের ৪৪/২১৫ নং হোল্ডিংয়ে পাঁচ একর পাহাড় রয়েছে মৃত ডা. ধর্ম জ্যোতি চাকমার ছেলে অনির্বান চাকমার নামে। এই পাঁচ একর পাহাড়ের মধ্যে চার একর পাহাড় পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন উপ-প্রকল্প স্থাপনে অধিগ্রহণের জন্য রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের নিকট আবেদন করেন রাঙামাটি পৌরসভার মেয়র মো. আকবর হোসেন চৌধুরী।

পরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এস.এ শাখায় দায়িত্বরত কানুনগো অরুণ চন্দ্র তালুকদার ও সার্ভেয়ার কাজী ফরিদ উদ্দীন সরেজমিন পরিদর্শন করে ভূমি রেকর্ড প্রতিবেদন দায়ের করেন। এতে কানুনগো অরুন চন্দ্র তালুকদার ও সার্ভেয়ার কাজী ফরিদ উদ্দীন ওই ভূমির চৌহদ্দিতে উল্লেখ করেন, উত্তরে ঝিরি ও খাস পাহাড়, দক্ষিণে রাঙ্গাপানিছড়া তথা পাহাড়, পূর্বে নিখিল দেওয়ানের পাহাড়, আর পশ্চিমে সরকারি রাস্তা। বিস্তৃর্ণ এই পাহাড়ের মধ্যভাগে অনির্বান চাকমার পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া ব্যক্তিমালিকানাধিন জমি। তার পাঁচ একর পাহাড়ের মধ্যে চার একর পাহাড়কে দ্বিতীয় শ্রেণি দেখিয়ে রেকর্ডভূক্ত করেন এস.এ শাখার কানুনগো অরুন চন্দ্র তালুকদার ও সার্ভেয়ার কাজী ফরিদ উদ্দীনসহ সংশ্লিষ্ট একটি চক্র।

শুকুরছড়ির ত্রিদিব নগরে ভূমির সরকারি মৌজা দর কিসের ভিত্তিতে নির্ধারণ হয় এবং সেখানে বর্তমানে সরকারি মৌজা দর কত? এই দুই প্রশ্নের জবাব জানতে চাওয়া হয় রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এস এ শাখার বড় বাবু হিসেবে পরিচিত মায়াদেবী চাকমার নিকট। তবে মায়াদেবী চাকমা প্রশ্নের পরপরই বিষটি সরাসরি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, এই বিষয়ে জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া কথা বলা যাবে না। তবে পরে অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব ভূমির মূল্য নির্ধারণ করেন এসএ শাখার সার্ভেয়ার ও কানুনগোরা। সরকারিভাবে এখানে ভূমির কোনো মূল্য নির্ধারিত নেই। ওরা কিভাবে এই মূল্য নির্ধারণ করেছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন।

অভিযোগ রয়েছে, রাঙামাটি পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন উপ-প্রকল্প স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণের খবর আগেভাগে জেনে যান পৌরসভার একটি চক্র। এরপরই পৌরসভা থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরের শুকুরছড়ির ত্রিদিব নগরের অনির্বান চাকমার কাছ থেকে তৃতীয় শ্রেণির পাহাড়ি চার একর ভূমি ১০ লক্ষ টাকায় কিনে নেয় তারা। পরে মন্ত্রণালয় থেকে ময়লা ডাম্পিংয়ের ভূমি ক্রয়ের অনুমতিপত্র পাওয়ার পরপই সেই পাহাড় চার কোটি ৩৭ লক্ষ ৩০ হাজার ২৪৫ টাকা মূল্যে পৌরসভাকে গছিয়ে দেওয়া হয়। আর এতে চার কোটি ২২ লক্ষ টাকার বেশি রাস্ট্রীয় অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বন্দোবস্তি সম্পন্ন করে সংঘবব্ধ চক্র।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, আমি এখানে যোগদানের আগ থেকেই বিষয়টি প্রসেজ করা ছিল। আমি আসার পর তা অগ্রগতি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি পরবর্তী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে। তিনি অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এখানে সরকারিভাবে ভূমির নির্ধারিত কোনো দর নেই। তাই একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। ওই কমিটির দেওয়া সিদ্ধান্ত অনুসরণ করেই ভূমি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

Print This Post Print This Post