আয়াত হত্যাকাণ্ড—দুই দিনের রিমান্ডে ঘাতক আবির

আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২২ ৮:৫৯ অপরাহ্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক | আপডেট : ২৬ নভেম্বর, ২০২২ শনিবার : ৮.৫৬ পিএম

নগরের বন্দরটিলা এলাকার আকমল আলী রোডে আলীনা ইসলাম আয়াতকে অপহরণের পর হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত আবীর আলীর দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। শনিবার (২৬ নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাদ্দাম হোসেনের আদালত এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্টোর পরিদর্শক ইলিয়াস খান বলেন, শিশু আয়াতকে অপহরণের পর হত্যা করে ৬ খণ্ড করায় অভিযুক্ত আবির আলীর জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। আদালত শুনানি শেষে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

জানা যায়, বাড়ির পার্শ্ববর্তী মসজিদে আসরের সময় আরবি পড়তে যায় পাঁচ বছর বয়সী আলিনা ইসলাম আয়াত। এসময় তাদের ভাড়াটিয়া আবির আলী মাদ্রাসার মাঠ থেকে তাকে কোলে নিয়ে আদর করে। এরপর চিপসের লোভ দেখিয়ে তাকে নিয়ে যায় আবিরদের ভাড়া বাসায়। সেখানে শিশু আয়াত চিৎকার করলে ১৫ মিনিটের মাথায় তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে আবির। এর পরপরই সে আয়াতের নিথর দেহ একটি কাপড়ের ব্যাগে ঢুকিয়ে সিইপিজেডের আকমল আলী রোডের পকেট গেট এলাকায় নিজেদের পুরনো বাসায় নিয়ে যায়।

সেখানে আবির তার মা আর বোনকে জানায়, সে ওই বাসা (আয়াতদের ভাড়া বাসায়) থেকে কিছু পুরনো কাপড়চোপড় বেঁধে নিয়ে এসেছে। এইবলে সে কাপড়ের ব্যাগটি সেই বাসার একটি কক্ষের ‘ফলস ছাদে’ রেখে দেয়। এরপর তার মা অন্য রুমে চলে গেলে আবির ওই ব্যাগ থেকে আয়াতের নিথর দেহ বের করে বটি এবং অ্যান্টি কাটার দিয়ে আয়াতকে ছয় টুকরো করে। পরে আয়াতের শরীরের সেই ছয় টুকরো আবার ব্যাগের মধ্যে রেখে দেয় এবং ফ্লোরে পরা রক্তগুলো পাউডার দিয়ে মুছে ফেলে। গন্ধ এড়াতে করা হয় রুম স্প্রে। এরপর সে পরিবারের সঙ্গে ভালোভাবে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে যায়। পরদিন সকালে আবির প্রথমে আয়াতে শরীরের ৩ টুকরা আকমল আলী রোডের একটি পাশের খালে ফেলে দেয়। বিকেলের পর বাকি ৩ টুকরা স্লুইচ গেটে ফেলে দেয়।

আয়াত নিখোঁজের ১০ দিনের মাথায় আবির আলী নামের এক যুবককে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে এ নিখোঁজ রহস্য উদঘাটন করে পিবিআই।

গ্রেপ্তার আবির সিইপিজেডের আকমল আলী রোডের পকেট গেট এলাকায় তার মা ও বোনকে নিয়ে থাকতো। আর তার বাবা ও আরেক বোন আয়াতদের ভাড়া বাসায় থাকতো। তাদের বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জে। আবির বেকার ও স্থানীয়ভাবে শর্টপিস ক্রিকেট টিমে ভাড়ায় খেলতো বলে জানা গেছে।

ঘটনাস্থল ঘুরে আসা পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক ইলিয়াস খান জানান, শিশু নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে র‌্যাব পুলিশের পাশাপাশি ছায়া তদন্তে নামে পিবিআই। তবে কারা অপহরণ করেছে বা কেন নিয়ে গেছে তেমন সূত্রে জানতে পারেনি। পরে আয়াত নিখোঁজ হওয়া ঘটনাস্থলে গিয়ে ওইখানে থাকা কয়েকজন বাচ্চা শিশুদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আয়াত যখন মাদ্রাসা পড়তে যায় তখন আসরের আজান দিচ্ছিল। তাই শিশু আয়াত মাদ্রাসা মাঠে খেলা করছিল। এসময় তাদের পুরনো ভাড়াটিয়া আবির এসে তাকে কোলে নিয়ে আদর করে এবং চিপস খেতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। পরে একটি রিকশা ডেকে শিশু আয়াতকে নিয়ে তাদের ভাড়া বাসায় যায় আবির। এরপর থেকেই আবিরকে সন্দেহ মনে হওয়ায় তাকে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হয়। শেষমেষ তাকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় আকমল আলী রোডের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পিবিআইয়ের একটি টিম। রাতভর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে শিশু আয়াত অপহরণসহ তাকে মেরে লাশ টুকরা করা ও সাগরপাড়ে ফেলে দেওয়ার কথা স্বীকার করে নেয় পাষণ্ড আবির আলী।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আবির আলীর পরিবার আয়াতদের ভাড়া বাসায় থাকতো। তার বাবা ও মায়ের মধ্যে ঝগড়া হওয়ায় তারা আলাদা বাসায় থাকে। এরমধ্যে তার বাবা ও বোন এখনও আয়াতদের ভাড়া বাসায় থাকে। আর অন্যদিকে সে এবং তার মা আকমল আলী রোডের পকেট গেট এলাকায় থাকতো। তবে তার ইচ্ছে সে বড় কোনো ফ্ল্যাট নিয়ে সেখানে তার পুরো পরিবারকে নিয়ে থাকবে। আর সেই চিন্তাধারা থেকে সে অপহরণের পরিকল্পনা আঁকে। দেড় মাস ধরে করা পরিকল্পনা মতে সে আয়াতকে টার্গেট করে এবং সুযোগ বুঝে তাকে অপহরণও করে। আর দাবিও ছিল আয়াতের মুক্তিপণ হিসেবে দিতে হবে ২০ লাখ টাকা। কিন্তু আয়াতকে অপহরণের পরে আয়াত চিৎকার করলে তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে। আকমল আলী সড়কের বাসায় নিয়ে ছয় টুকরো করে। তারপর কাট্টলীর সাগরপাড়ে ফেলে দেয়। গ্রেপ্তারের পর আবির আলী সব কিছু স্বীকার করে নেয়। মরদেহ টুকরো করার কাজে ব্যবহার করা বটি ও অ্যান্টি কাটার উদ্ধার করা হয়েছে আবির আলীর বাসা থেকে। এখন আমরা লাশের টুকরোগুলো উদ্ধারে সাগর পাড়ে আছি।’

পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা বলেন, ‘মূলত মুক্তিপণ দাবির জন্যই আবির আলী তার বাড়িওয়ালার নাতনিকে অপহরণ করে। কিন্তু মেয়েটি চিৎকার করায় তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। পরবর্তীতে লাশ গুম করতে ছয় টুকরো করা হয়। গ্রেপ্তারের পর সব কিছুই স্বীকার করে নেয় সে। আয়াতের খণ্ডিত মাংসপিণ্ডগুলো উদ্ধারে ডুবুরি দলের পাশাপাশি আমাদের তিনটি টিম কাজ করছে। তবে আজ পুরো দিনেও কোন অংশই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।’

ইপিজেড থানার দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের নয়ারহাট এলাকার বাসিন্দা সোহেল রানা ও সাহিদা আক্তার তামান্না দম্পতির মেয়ে আয়াত। তিনতলা ভবনের মালিক সোহেলের ওই এলাকায় একটি মুদির দোকান আছে। আয়াত স্থানীয় তালীমূল কোরআন নূরানী মাদরাসার হেফজখানার ছাত্রী ছিল। গত ১৫ নভেম্বর চট্টগ্রামের ইপিজেড থানার বন্দরটিলার এলাকার নয়ারহাট বিদ্যুৎ অফিস এলাকার বাসা থেকে পার্শ্ববর্তী মসজিদে আরবি পড়তে যাওয়ার সময় নিখোঁজ হয় আলিনা ইসলাম আয়াত। এর পরদিন শিশুর বাবা সোহেল রানা এ ঘটনায় ইপিজেড থানায় নিখোঁজের ডায়েরি করলেও কোন হদিস মিলেনি। অবশেষে নয় দিন পর এ নিখোঁজ রহস্যের জট খুললো। তবে এখনো পর্যন্ত খণ্ডবিখণ্ড আয়াতের লাশের টুকরো উদ্ধার হয়নি।

সিটিজিসান/এমবিইউ