দূরত্ব বাড়ছে র‌্যাব-পুলিশের

আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৬ ২:৩৯ অপরাহ্ন

66666

অনলাইন ডেস্ক ::
এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাব ও পুলিশের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছেই। হালে এই দূরত্ব দ্বন্দ্বে রূপ নিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, পুলিশ ও পুলিশের সহায়ক শক্তি র‌্যাবের মধ্যকার এই দ্বন্দ্ব এখন আর গোপন নেই। বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরে পুলিশের কতিপয় সদস্যের বিরুদ্ধে র‌্যাব প্রধানের একটি লিখিত অভিযোগের বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর তোলপাড় শুরু হয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে।

র‌্যাব প্রধানের লিখিত ওই অভিযোগে বলা হয়, ‘র‌্যাব সদস্যদের পুলিশ হেনস্তা করছে, দায়ী পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে। পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্রধারী দুটি দলের মধ্যে বড় ধরনের দুর্ঘটনা সৃষ্টি হতে পারে।

এ ছাড়া পুলিশ বাহিনী তথা সরকারের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হতে পারে।’ তবে র‌্যাব এবং পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ নিয়ে কেউ প্রকাশ্যে কথা বলছেন না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিষয়টি বড় কিছু নয়। র‌্যাব-পুলিশের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। সব বাহিনীর ভিতরেই ছোটখাটো সমস্যা থাকে। বড় করে দেখার বিষয় নয়।

র‌্যাব প্রধানের অভিযোগের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন. পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তদন্তের জন্য। লিখিত অভিযোগের বিষয়ে পুলিশের আইজি এ কে এম শহীদুল হক গত বুধবার সাংবাদিকদের বলেছেন, অভিযোগ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশ ও র‌্যাবের মধ্যে দূরত্ব আমাদের জননিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। দুই বাহিনীর দ্বন্দ্বে দুর্বৃত্তরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। সরকারের উচিত খুবই কঠোর ও সতর্কতার সঙ্গে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, পুলিশ ও র‌্যাবের মধ্যে দূরত্ব আমাদের জননিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। পুলিশের ব্যর্থতার কারণে ২০০৪ সালে র‌্যাব গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু জননিরাপত্তা রক্ষায় পুলিশের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। র‌্যাব পুলিশের অধীনে হলেও এই এলিট বাহিনী র‌্যাবের নিজস্ব একটা ইমেজ তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, র‌্যাব প্রধানের চিঠিতে প্রমাণ হয় দ্বন্দ্বের মাত্রাটা কতটুকু। তাই সমস্যা নিরসনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে খুব শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, র‌্যাবকে আলাদা স্বতন্ত্র বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা হলে হয়তো যে সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে দুই বাহিনীর মধ্যে, তা হয়তো হবে না।

সংশ্লিষ্ট দুই বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, র‌্যাব-পুলিশের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। বিষয়টি গোপন হলেও মাঝে মধ্যে তা প্রকাশ্য রূপ পায়। অপরাধী গ্রেফতারে প্রতিযোগিতার মনোভাব থেকেই মূলত এই দুই বাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। বেশ কিছু ঘটনার পর এই দ্বন্দ্ব পরবর্তীতে প্রকাশ্যে কাদা ছোড়াছুড়িতে রূপ নেয়। নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের পর পুলিশ ও র‌্যাবের মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ পায়।

সূত্রগুলো জানায়, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে কয়েক বছর আগে র‌্যাব-৩-এর কোম্পানি কমান্ডারসহ ১৮ সদস্যকে তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নেয় র‌্যাব সদর দফতর। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে র‌্যাবের ভাবমূর্তির কথা ভেবে খবরটি যাতে মিডিয়ায় না আসে সে জন্য কৌশল নেয় র‌্যাব সদর দফতর। কিন্তু ঢাকা মহানগর পুলিশের নিউজ পোর্টাল ডিএমপি নিউজে ওই খবরটি ফলাও করে প্রচার করা হয়।

এ ঘটনার জন্য র‌্যাব কর্মকর্তারা পুলিশের কতিপয় অতি উৎসাহী কর্মকর্তাকে দায়ী করেছিলেন। তবে পুলিশ কর্মকর্তাদের বক্তব্য, ডিবির একজন ডিসির বিরুদ্ধেও এক কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগও মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। ডিবি ওই ঘটনাটি গোপন করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। মিডিয়ায় সংবাদটি প্রকাশিত হলে ডিবি ইমেজ সংকটে পড়ে।

এর আগে কেরানীগঞ্জের স্কুলছাত্র পরাগ মণ্ডল অপহরণের ঘটনা ঘটে। ওই সময় ডিবি পুলিশ দাবি করেছিল মুক্তিপণের টাকা ছাড়াই পরাগকে উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু র‌্যাব থেকে বলা হয়, পুলিশ পরাগকে উদ্ধার করেনি; শিশুটির বাবা মুক্তিপণের টাকা দিয়েই অপহরণকারীদের আস্তানা থেকে পরাগকে ফেরত এনেছে— এমন তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। র‌্যাবের এই বক্তব্য নিয়েও পুলিশ বেশ ক্ষুব্ধ হয়। দূরত্ব বাড়তে থাকে এই দুই বাহিনীর মধ্যে।

সূত্র জানায়, মহাখালীতে বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও চিকিৎসক নেতা নারায়ণ চন্দ্র দত্ত হত্যা ও পুরান ঢাকায় পুলিশ কর্মকর্তা গৌতম রায় হত্যার আসামি গ্রেফতারের কৃতিত্ব নিয়ে র‌্যাব ও পুলিশের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়। পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে জানিয়েছিল এরাই খুনি।

কিন্তু র‌্যাব অন্য কয়েকজনকে গ্রেফতার করে দাবি করে, এরাই প্রকৃত খুনি। এমন আরও বেশ কয়েকটি ঘটনার পর দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করতে থাকে। দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে আসে নারায়ণগঞ্জ সাত খুনের ঘটনার পর। র‌্যাব কর্মকর্তা খুনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার পর তদন্তে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে র‌্যাব প্রশ্ন তুলেছিল।

সূত্র জানায়, সর্বশেষ গত ২৭ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের বরাবরে র‌্যাব প্রধান বেনজীর আহমেদের একটি চিঠি আবারো পুলিশ ও র‌্যাবের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওই চিঠিতে র‌্যাব প্রধান লিখেছেন, ‘দায়িত্ব পালনের সময় পরিচয় দেওয়ার পরও কিছু পুলিশ সদস্য গালাগাল ও মারধর করেছে র‌্যাব সদস্যদের।

শুধু তাই নয়, লাঠি ও রাইফেল দিয়েও আঘাত করে রক্তাক্ত করা হয়েছে র‌্যাব সদস্যদের।’ ওই চিঠিতে র‌্যাবের ডিজি বলেন, ‘সারা দেশের র‌্যাব ক্যাম্প থেকে প্রতিনিয়ত র‌্যাবের অসংখ্য আভিযানিক ও গোয়েন্দা দল এবং প্রশাসনিক দল সরকারি কাজে প্রয়োজনে ইউনিফর্ম বা সাদা পোশাকে সশস্ত্র বা নিরস্ত্র অবস্থায় সরকারি যানবাহনে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে।

সম্প্রতি এসব অভিযান বা সরকারি কার্যক্রম পরিচালনাকালে র‌্যাবের আভিযানিক ও গোয়েন্দা দলের সদস্যরা র‌্যাবের পরিচয় দেওয়ার পরেও পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য তাদের সঙ্গে অশ্লীল ভাষায় আক্রমণাত্মক কথা বলে, বিভিন্ন বাহিনী সম্পর্কে কটূক্তিপূর্ণ মন্তব্যসহ শারীরিকভাবে হেনস্তা করে। কিছু ক্ষেত্রে র‌্যাবের সদস্যদের লাঠি ও রাইফেল দিয়ে আঘাত করে রক্তাক্ত করেছে পুলিশ।’

সিনিয়র সচিব বরাবরে লেখা অভিযোগে র‌্যাবের ডিজি বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘এ ব্যাপারে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে পরবর্তী সময়ে অস্ত্রধারী এই দুটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে এরূপ ঘটনা ঘটলে যে কোনো সময়ে তা বড় ধরনের দুর্ঘটনা সৃষ্টি করতে পারে। যা পুলিশ বাহিনী তথা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে। এসব ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পত্রালাপ করা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এমনকি এ বিষয়ে নেওয়া কার্যক্রম সম্পর্কেও র‌্যাবকে অবগত করা হয়নি। যা র‌্যাব সদস্যদের মনোবল ভাঙন ধরাতে পারে।

একইসঙ্গে আভিযানিক কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে।’ চিঠিতে র‌্যাবের ডিজি আরও বলেন, ‘অধিকাংশ সময়েই দেখা যায়, র‌্যাবের পরিচয় পাওয়ার পরও পুলিশ সদস্যরা র‌্যাব সদস্যদের ওপর চড়াও হচ্ছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই র‌্যাব সদস্যরা আক্রান্ত হলেও অত্যন্ত ধৈর্য, পেশাদারি মনোভাব ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে নি। সুত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

সিটিজিসান.কম/শিশির

Print This Post Print This Post