গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আইনে আছে বাস্তবে নেই

আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৬ ৯:৫০ অপরাহ্ন

5c71ed52dfbdca16cfc94d7c6cd8ff58-round

অনলাইন ডেস্ক :: ​রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন বিভিন্ন দেশ থেকে আগত সম্পাদক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা জগতের বিশিষ্টজনেরা।

ছিলেন প্রথম আলোর বিভিন্ন বিভাগের প্রধান ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে আইনগতভাবে মুক্ত গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ কম। কখনো রাজনৈতিকভাবে, কখনো ব্যবসায়িক, আবার কখনো ধর্মীয় স্পর্শকাতরতার অজুহাতে গণমাধ্যমের স্বাধীন মতপ্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টেলিভিশন মিডিয়ার ক্রমবিকাশে সাংবাদিকতার ধারা পাল্টে গেছে। এ দুটি মাধ্যম অনেকটা মতামতধর্মী। সেই ধারাটিই এখন প্রকৃত সাংবাদিকতার ওপর চেপে বসেছে, যার কারণে হারাতে বসেছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার আদি ধারা। খবর প্রথম আলো’র।

বক্তব্য দিচ্ছেন ভারতের ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দুর সম্পাদক মুকুন্দ পদ্মনাভন। ছবি: জাহিদুল করিমপ্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে যুক্তরাজ্য, ফিনল্যান্ড, ভারত, নেপাল, ভুটান, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, স্লোভাকিয়াসহ বিশ্বের নয়টি দেশ থেকে আসা সংবাদপত্রের সম্পাদক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা জগতের বিশিষ্টজনেরা এসব অভিমত তুলে ধরেন। আজ শুক্রবার সকালে বাংলাদেশে আগত এই বিদেশি অতিথিরা রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে গণমাধ্যমের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এক মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন।

সেখানে ২০ জন বিদেশি অতিথি তাদের নিজ নিজ দেশ ও সংবাদমাধ্যমের অভিজ্ঞতার আলোকে সংবাদপত্রের বর্তমান ভূমিকা, বিদ্যমান সংকট ও করণীয় বিষয়ে মত দেন। এ সময় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংবাদ আদান-প্রদান ও সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হয়।

বিশ্ব গণমাধ্যমের ভূমিকা পর্যালোচনা করতে গিয়ে আলোচকদের কেউ কেউ বলেছেন, সাংবাদিকতা এখনো অনেকটাই নগরকেন্দ্রিক। যার কারণে বিপুলসংখ্যক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মতামত গণমাধ্যমে যথাযথভাবে উঠে আসছে না। এর চরম উদাহরণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফল। যেখানে সব গণমাধ্যমের সব ধরনের পূর্বাভাসকে মিথ্যা করে দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।

ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ আলোচনায় স্বাগত ও সমাপনী বক্তব্য দেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানসহ প্রথম আলোর বিভিন্ন বিভাগের প্রধান ও জ্যেষ্ঠ সংবাদকর্মীরা।

প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা এসব প্রখ্যাত সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সামনে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন ও তথ্যচিত্রের মাধ্যমে প্রথম আলোর সাংবাদিকতা ও সামাজিক বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরা হয়। অতিথিরা প্রথম আলোর বস্তুনিষ্ঠ, সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতা এবং সামাজিক কার্যক্রমের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা এ মুক্ত আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ও সাংবাদিকতার শিক্ষা, সংবাদপত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে সঠিক সাংবাদিকতার হুমকি, নগরকেন্দ্রিক সাংবাদিকতার প্রভাব ইত্যাদি বিষয় আলোচনায় প্রাধান্য পায়।

বক্তব্য দেন বিবিসি স্কটল্যান্ডের উত্তর-পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলীয় দ্বীপবিষয়ক ব্যবস্থাপনা সম্পাদক স্যান্ডি ব্রেমনার। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আইনে আছে বাস্তবে নেই।

বিশ্বের সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের প্রকাশকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ান-ইফরার দক্ষিণ এশিয়া শাখার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাগদুম মোহামেদ বলেন, ‘আইনে আমাদের গণমাধ্যমের ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। কিন্তু বাস্তবে নেই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সবার নজর দেওয়া উচিত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী চলছে, আমরা কি সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছি? আমাদের সেদিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। আমাদের মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা করতে হবে।’

ভারতের অন্যতম দৈনিক ভাস্কর পত্রিকার গ্রুপ এডিটর ও এডিটরস গিল্ড অব ইন্ডিয়ার সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ দুবে বলেন, প্রত্যেক দেশের সংবিধানে, আইনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেটা যখনই বাস্তবায়নের সময় আসে তখনই ক্ষমতাসীনেরা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রেস কাউন্সিল আছে, সবকিছু আছে। কিন্তু সবকিছুকে এড়িয়ে তারা (ভারত সরকার) তথ্য মন্ত্রণালয়ের কমিটির সুপারিশে এক দিনের জন্য এনডিটিভি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিল।

অস্ট্রিয়াভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউটের (আইপিআই) নির্বাহী বোর্ডের চেয়ারম্যান জন ইয়ারউড বলেন, এ কয়েক দিন আগেই তিনি তুরস্কে ও জাম্বিয়ায় বিরোধী মতের পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা দেখেছেন। সেখানকার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, যেকোনো সমাজের জন্যই মুক্ত গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা জরুরি।

এশিয়া ও লাতিন আমেরিকায় ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া সাপোর্টের (আইএমএস) কর্মসূচি ব্যবস্থাপক এসবেন কিউ হারবো বলেন, ‘সারা বিশ্বের গণমাধ্যম আজ সংকটে। কারণ বিশ্বব্যাপী পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা ছড়ানো হচ্ছে। সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনা বাড়ছে। গত ১৮ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাজার খানেক সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের মধ্যে এখন ঐক্য খুবই দরকার।’
ইন্দো-বাংলা মৈত্রী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শুভদ্বীপ দত্ত প্রথম আলোকে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যা​ওয়ার পরামর্শ দেন।

নেপালের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক কান্তিপুরের প্রধান সম্পাদক সুধীর শর্মা বলেন, নেপালের সংবিধানে মুক্ত গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলা আছে। তা সত্ত্বেও স্বাধীন মতপ্রকাশ করতে গিয়ে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। সঠিক সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে ব্যবসায়ী মহল ও রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে প্রবল চাপের মুখে পড়তে হয়। বর্তমানে বড় বড় ব্যবসায়ী মিডিয়াতে বিনিয়োগ করছেন। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য যতটা না সৎ সাংবাদিকতা, তার চেয়ে বেশি অন্য স্বার্থ।

বক্তব্য দিচ্ছেন ভারতীয় দৈনিক ই​ন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রধান সম্পাদক রাজ কমল ঝা। ছবি: জাহিদুল করিমভারতের দৈনিক দ্য হিন্দুর সম্পাদক মুকুন্দ পদ্মনাভন বলেন, ‘ভারতেও পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের মামলা দিয়ে হয়রানির ধরনটা বাংলাদেশের মতো। মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার পেছনেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। ঢাকায় আসার পথে সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে বসে একটি ফোন কলে জানতে পারলাম যে আমার বিরুদ্ধে ২০ বছর আগের পুরোনো একটি মামলা পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। জেলা পর্যায়ে যাঁরা সাংবাদিকতা করেন, তাঁদের স্থানীয় প্রশাসনের হুমকির মুখে থাকতে হয় প্রতিনিয়ত।’

এ সময় তিনি বলেন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে তা তৃণমূল পর্যায় থেকেই করা জরুরি।

ত্রিপুরার দৈনিক দেশের কথার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক গৌতম দাশ বলেন, ‘স্বাধীন মতপ্রকাশ করতে গিয়ে আমার পত্রিকার ওপর ৫০০ বারের বেশি আক্রমণ হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়ে চাপ তৈরি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে মামলা তো রয়েছেই। সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে ভারতে প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ দায়েরের বিধান থাকলেও তা মানা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে প্রেস কাউন্সিলকে পাশ কাটিয়ে সরকারি সিদ্ধান্তে সংবাদমাধ্যম বন্ধের নজিরও ভারতে রয়েছে। এ সময় তিনি প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন।’

ভারতের মেঘালয়ের পুরোনো ও বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক দ্য শিলং টাইমসের সম্পাদক প্যাট্রিসিয়া মুখিম বলেন, ‘ভারতে আইনগতভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে সবাই নিজেদের মনের কথা মন খুলে বলতে পারে না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতায় দরকার, যেখানে আমার মনের কথা আমি মন খুলে বলতে পারব।’

অনুষ্ঠানে ছিলেন ভারতভিত্তিক সাউথ এশিয়ান উইমেন ইন মিডিয়ার প্রেসিডেন্ট জ্যোতি মালহোত্রা। ছবি: জাহিদুল করিমশহুরে সাংবাদিকতা, মার্কিন নির্বাচনের ভুল পূর্বাভাস।

সাংবাদিকতা এখনো শহরের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ উল্লেখ করে ভারতের দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক স্বাতী ভট্টাচার্য বলেন, ‘তেতাল্লিশের মন্বন্তর নামে পরিচিত সেই মহাদুর্ভিক্ষ যতক্ষণ না কলকাতা শহরে হানা দিয়েছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত গণমাধ্যমগুলো নীরব ছিল। কলকাতা শহরের অলিগলিতে যখন দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকা শুরু করল, তখন গণমাধ্যমগুলো সংবাদ প্রকাশ করা শুরু করল। আমাদের এখনো এ অবস্থা রয়ে গেছে। মফস্বলের সাংবাদিকতা অনেকটাই জেলা প্রশাসক আর জেলার পুলিশ প্রধানের কার্যালয়নির্ভর। এর বাইরে গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা গণমাধ্যমে খুব কমই উঠে আসছে। সাংবাদিকেরা খুব কমই গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন। গ্রামের হাসপাতালগুলোতে কী অবস্থা, স্কুলগুলোতে কী পড়ানো হচ্ছে—এ বিষয়গুলোকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না।’

দু-এক দিনের মধ্যেই পড়া একটি নিবন্ধের উল্লেখ করে স্বাতী বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মতামতকে উপেক্ষা করার কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমগুলো সদ্য শেষ হওয়া নির্বাচন সম্পর্কে ভুল পূর্বাভাস দিয়েছিল। যার কারণে সব গণমাধ্যম হিলারির বিজয়ের সম্ভাবনার কথা বললেও সবকিছু মিথ্যা প্রমাণিত করে শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পই জয়ী হয়েছেন।

নিজের মত তুলে ধরেন ভুটানের জাতীয় দৈনিক কুয়েনসেল-এর সম্পাদক রিনঝিন ওয়াংচুক। ছবি: জাহিদুল করিমগণমাধ্যমে আস্থা বাড়ছে, না কমছে
প্রায় ১০০টি দেশের সাংবাদিক, সম্পাদক ও গণমাধ্যম নির্বাহীদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক বারবারা ত্রিয়োনফি বলেন, ‘আমাদের দেশের (সাধারণভাবে ইউরোপে) মানুষ গণমাধ্যমে বিশ্বাস করে না। তারা সাংবাদিকদের কাছে যায় না। তারা যায় রাজনীতিবিদদের কাছে। সাংবাদিকদের সংকটগুলো আমরা জানি।’

ভুটানের জাতীয় দৈনিক কুয়েনসেলের সম্পাদক রিনঝিন ওয়াংচুক বলেন, ‘সেল্ফ সেন্সরশিপ’ এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভুটান ছোট দেশ। এখানে পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে অনেক রকমের অনুরোধ আসে; যার কারণে কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করা সম্ভব হয় না। ভুটানের গণমাধ্যম দৈনন্দিন ঘটনা কাভারেই ব্যস্ত।

তবুও ভুটানে গণমাধ্যমের প্রভাব বাড়ছে উল্লেখ করে কুয়েনসেল পত্রিকার প্রকাশনা বিভাগের সম্পাদক উখিয়্যান পেনজর বলেন, আগে কোনো সমস্যা হলেই মানুষ রাজার কাছে যেত। কিন্তু এখন তারা সাংবাদিকদের কাছে যাচ্ছে। এমনকি আদালতে হেরে গেলেও তারা সাংবাদিকের কাছে আসছে। তিনি বলেন, সকালবেলা উঠে পত্রিকায় এত যুদ্ধ, হত্যার খবর পড়ে মানুষ ক্লান্ত, বিরক্ত। এ জন্য পত্রিকায় কিছু ইতিবাচক খবর থাকা উচিত।

স্লোভাকিয়ার দৈনিক এসএমইতে কর্মরত সাংবাদিক মাতুস কেরাসিমারিক বলেন, মানবাধিকার প্রশ্নে সংবাদমাধ্যমগুলোকে দায়িত্ববান হতে হবে।
বক্তব্য দেন ভারতীয় দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক স্বাতী ভট্টাচার্য। ছবি: জাহিদুল করিমনারী সাংবাদিকদের মূলধারায় নিয়ে আসা

দৈনিক আনন্দবাজারের স্বাতী ভট্টাচার্য বলেন, গণমাধ্যমে মূলধারার কাজে অর্থাৎ রিপোর্টিংয়ে মেয়েদের উপস্থিতি একেবারেই নেই। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোনো জেলায় তিনি একজনও নারী রিপোর্টার দেখেননি। তিনি প্রশ্ন তোলেন, এটা তাহলে কেমন গণতন্ত্র, যেখানে মেয়েদের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই।

ভারতের মেঘালয়ের পুরোনো ও বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক দ্য শিলং টাইমসের সম্পাদক প্যাট্রিসিয়া মুখিমও সাংবাদিকতায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর তাগিদ দেন। তাঁর মতে, বিপুল নারী জনগোষ্ঠীর মতামতকে সংবাদপত্রে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরতে হলে তাদের যুক্ত করার কোনো বিকল্প নেই।

আসামের সাময়িক প্রসঙ্গ-এর সম্পাদক তৈমুর রেজা চৌধুরী বলেন, নারী সাংবাদিকদের মূলধারায় আসা উচিত।

এ ছাড়া ভারতভিত্তিক সাউথ এশিয়ান উইমেন ইন মিডিয়ার প্রেসিডেন্ট জ্যোতি মালহোত্রা বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংবাদ বিনিময়ের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ছাপা কাগজের সংবাদ বিনিময় সম্ভব না হলে প্রযুক্তির সহায়তায় ডিজিটাল কনটেন্ট শেয়ার করতে পারি আমরা।’

এ সময় ভিন্নধর্মী প্রচেষ্টা বা উদ্যোগগুলোকে সমন্বিতভাবে তুলে ধরার পরামর্শ দেন। তাঁর মতে, এতে ভালো কাজে আগ্রহ আরও বাড়বে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব।

সাংবাদিকতার ওপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভারতের দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রধান সম্পাদক রাজ কমল ঝা বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের কারণে সবাই নিজেকে ভাবছে সাংবাদিক। সবার হাতে হাতে ছবি তোলার মতো মোবাইল, যে কেউ যেকোনো কিছু লিখতে পারছে, যা খুব সহজেই ছড়িয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিকদের তথ্য যাচাইয়ের বিষয়গুলো দেখতে হবে। আজকের এ যুগে সবার মত আছে। সবাই সে মতটা চাপিয়ে দিতে চায়। তিনি বলেন, টিভিতে কেউ কেউ এসে কথা বলে অনেক বড় তারকা বনে যাচ্ছেন। তাঁরা এসে সরকারের পক্ষে কথা বলছেন, তাঁরা এমনও বলছেন যে সাংবাদিকদের (পেশাদার) গ্রেপ্তার করতে হবে। আজকে তাঁরা উন্নয়ন ও জাতীয়তাবাদকে সাংবাদিকতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন।

রাজ কমলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) দক্ষিণ এশিয়া সংবাদ পরিচালক বার্নাত আর্মেঙ বলেন, ‘আমাদের পাঠকদের মাধ্যম পরিবর্তন হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁরা আমাদের খবরগুলো দেখছেন, পড়ছেন। যে চ্যালেঞ্জগুলো এখন তৈরি হচ্ছে, সেগুলো মোকাবিলার জন্য ঐক্য প্রয়োজন।

ফিনল্যান্ডের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক হেলসিঙ্গিন সানোমাটের কূটনৈতিক সম্পাদক কারি হুতা বলেন, ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার হামলা, ব্রেক্সিট, ট্রাম্পের বিজয়—সবকিছু মিলিয়ে গত কয়েক দিনেই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট অনেকখানি পাল্টে গেছে। সাংবাদিকতার দিক থেকে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে।’

নেপালের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক কান্তিপুরের প্রধান সম্পাদক সুধীর শর্মাও ছাপা পত্রিকা ও সাংবাদিকতার জন্য তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবিকাশ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম। পাশে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। ছবি: জাহিদুল করিমসঞ্চালকের বক্তব্য : আলোচনার সঞ্চালক ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম বলেন, পৃথিবীজুড়ে সংবাদপত্রের ভাষা হয়তো ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু সাংবাদিকতার আবেগ ও ধরন একই। সমস্যাগুলোও প্রায় একই। তাই এখন সময় এসেছে সংহতির। পারস্পরিক যোগাযোগকে আরও বেশি সুদৃঢ় করার।

বর্তমান বাস্তবতায় বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমের জন্য তিনটি বিষয়কে প্রধানতম সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি। এগুলো হলো গণমাধ্যমের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, সরকার ও জাতীয় সমস্যা এবং আন্তর্জাতিকভাবে তৈরি হওয়া উগ্রবাদ, বর্ণবাদ ও ধর্মান্ধতা। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কথা বলে সাম্প্রদায়িক নানা ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। কিন্তু ধর্মীয় স্পর্শকাতরতার জন্য সেখানে গণমাধ্যমগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না।

আলোচনার শেষ ভাগে এক ভিডিও বার্তায় শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) নির্বাহী পরিচালক জোয়েল সায়মন। তিনি প্রথম আলোর ১৮ বছরের সাহসী সাংবাদিকতার প্রশংসা করে এ ধারা আগামীতেও অব্যাহত রাখার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

সিটিজিসান.কম/রবি

Print This Post Print This Post