পার্বত্য চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার গাইড লাইন

আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৯ ৮:৪১ অপরাহ্ন

২১ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:১০ এএম

সৈয়দ ইবনে রহমত : : তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি এবং বান্দরবান হঠাৎ করেই অশান্ত হয়ে পড়ছে। দু’দিন পর পর সেখানে অনাকাক্সিক্ষতভাবে রক্ত ঝরছে। খুনখারাবির পাশাপাশি চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজিসহ নানা রকম সন্ত্রাসী কার্যক্রমের শিকার হচ্ছে পার্বত্যবাসী। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন জাতীয় এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, এমনকি খোদ সেনাবাহিনীর সদস্যরাও সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে হতাহত হচ্ছেন। ফলে ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পার্বত্য চট্টগ্রাম স্থানীয় জনসাধারণের মনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই অবনতি।

বিষয়টি যে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকেও ভাবিয়ে তুলেছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল দু’দিব্যাপী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি’র সাম্প্রতিক পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরের মধ্য দিয়ে। গত ১৬ অক্টোবর এবং ১৭ অক্টোবর সফর করে রাঙ্গামাটিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ের আয়োজনে তিন পার্বত্য জেলার বিশেষ আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত দুটি সভা করেছেন তিনি। একটি সভা তিনি করেছেন তিন পার্বত্য জেলার ডিসি, এসপিসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিয়ে। অপর সভাটি ছিল প্রশাসনিক এবং স্থানীয় প্রতিনিধিসহ অন্যান্যদের নিয়ে। এসব সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং, রাঙ্গামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার, খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, মহিলা সংরক্ষিত আসনের এমপি বাসন্তী চাকমা, পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম, পুলিশের মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ানের (র‌্যাব) মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, চট্টগ্রাম এরিয়া কমান্ডার সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমান, সার্কেল চিফ এবং জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানগণ উপস্থিত ছিলেন। নিকট অতীতে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধানদের নিয়ে এতটা উচ্চ পর্যায়ের সভা করার নজির নেই। তাই বিষয়টি পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোসহ স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে উদ্বিঘ্ন হওয়া পার্বত্যবাসীর মনেও কিছুটা আশার সঞ্চার করছে।

সভাগুলোর আগে-পরে প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে জানা গেছে, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস করছে, চাঁদাবাজি করছে, খুনখারাবি-রক্তপাত করছে, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সকল সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। আর যারা এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী কার্মকান্ডে মদত দিচ্ছে তারাও রেহাই পাবে না, তাদেরও বিচার হবে। কেউ যদি মনে করেন অথবা ঘরে বসে বসে চিন্তা করেন, অস্ত্রের মহড়া দিয়ে এই অঞ্চল অচল করে দেবেন, তাহলে সেটি তাদের জন্য স্বপ্নই থেকে যাবে, কখনো সফল হবে না। তিনি এটাও বলেছেন যে, আমরা ধৈর্য সহকারে মোকাবিলা করছি বলে মনে করবেন না যে আমাদের ক্ষমতা নাই। আমরা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই যে, ঘটনাগুলো জেনে গেলাম। এগুলো আমরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করবো এবং তিনি যাচাই বাছাই করে যে দিক নির্দেশনা দেবেন সেভাবেই যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তাছাড়া নিরাপত্তা বাহিনী এখন অনেক শক্তিশালী। তারা যেকোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতেও প্রস্তুত। তাই কাউকে পাহাড়ের শান্তি বিনষ্ট করতে দেওয়া হবে না। পাহাড় বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনী এ অঞ্চলে নিয়োগ করা হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গাইড লাইন তৈরির কাজ চলছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, শান্তিচুক্তির নিয়মানুযায়ী যেসব স্থান থেকে সেনা ক্যাম্প উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে সেখানে বিজিবি, পুলিশ এবং র‌্যাব মোতায়েন করা হবে। পুলিশ এবং বিজিবি’র জন্য আধুনিক সরঞ্জাম এবং হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়াও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য অন্যান্য লজিস্টিক সাপোর্ট (যন্ত্রপাতি সহযোগিতা) প্রদান করা হবে। এখানে কিছু দুর্গম এলাকা রয়েছে, সেখানে যাওয়ার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং একই সঙ্গে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করা হবে। এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য সকল ধরনের সহায়তা প্রদান করা হবে। তাছাড়া, সন্ত্রাসীদের উদ্দেশে শান্তির বার্তা দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ১৯৯৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তথা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস এনেছেন। এই ধারা অব্যাহত রাখা হবে। পাহাড়ি-বাঙালি সকল সম্প্রদায় যাতে মিলেমিশে বসবাস করতে পারে এ বৈঠকের মাধ্যমে সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা আত্মসমর্পণ করতে চাইলে ভেবে দেখা হবে, স্বাভাবিক জীবনে ফেরার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসীরা যদি ভুল স্বীকার করে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়, তাহলে সরকার বিষয়টি ভেবে দেখবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর, তিন পার্বত্য জেলার বিশেষ আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার গাইড লাইন তৈরি সম্পর্কে যেসব বক্তব্য গণমাধ্যমে এসেছে সেসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এসব উদ্যোগ পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় খুব বেশি প্রভাব ফেলবে, সে ব্যাপারেও নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। সমস্যার মূলে না গিয়ে শুধু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলে স্থায়ী শান্তির লক্ষ্য অর্জিত হবে না। কারণ, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাটি সুন্দরবন, মহেশখালী কিংবা কুতুবদিয়ার মতো না। আবার কক্সজাবারের মতোও না। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান সমস্যাটির গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রায় অনুরূপ দু’টি সমস্যাকে উদাহরণ হিসেবে ভেবে দেখা যেতে পারে। আমাদের নিকট প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কায় তামিল টাইগাররা এক সময় এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে, তারা সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিমান হামলা পর্যন্ত করেছে। তামিলদের আত্মঘাতী হামলায় একের পর এক ধ্বংস হয়েছে রাষ্ট্রীয় স্থাপনা, আক্রান্ত হয়েছে সে দেশের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনী। দেশের ভেতরে ও বাইরে তামিলদের শক্তিশালী অবস্থানের পাশাপাশি ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমর্থকগোষ্ঠিও ছিল। কিন্তু যখন শ্রীলঙ্কান সরকারের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল, তখন তারা খুব সংক্ষিপ্ত সময়ে সে সমস্যার মূল উৎপাটন করে ফেলেছে। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুরের ঘটনাও আমরা কমবেশি জানি। সেখানেও বিদ্রোহীরা সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। শেষ পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়া সরকার তাদের আলাদা করে দিয়ে সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে। অনুরূপ উদাহরণ আমাদের প্রতিবেশী ভারত এবং মিয়ানমারেও অনেক আছে। বাংলাদেশ সরকার চাইলে তেমন একটি পথেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানে অগ্রসর হতে পারত। সে যাইহোক, আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানে পূর্ব তিমুরের পথে যেমন হাঁটিনি, তেমনি তামিল টাইগার নির্মূলে শ্রীলঙ্কান পদ্ধতিও গ্রহণ করিনি। বরং ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর এক চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে উপরের দুটি উদাহরণের মাঝামাঝি পথ অবলম্বন করে তুলনামূলকভাবে সবার্ধিক শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের চেষ্টা করেছি। আর পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে বিরাজমান সমস্যার মূলও সেইখানেই নিহিত আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান সমস্যার সমাধান করতে হলে সেই চুক্তির বিভিন্ন ধারা-উপধারা এবং চুক্তি পরবর্তী সময়ে স্বাক্ষরকারী উভয় পক্ষ থেকে গৃহীত পদক্ষেপগুলো পর্যালোচনা করলেই সমাধানের পথ মিলতে পারে।

সরকারের সাথে চুক্তি করে তৎকালীন শান্তিবাহিনী তথা জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)’র সভাপতি সন্তু লারমা প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হয়ে দুই দশকের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। অন্যদিকে চুক্তির পর সকল অবৈধ অস্ত্র জমা দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি সেটা করেন নি। বরং অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের বিরাট ভান্ডার তিনি জঙ্গলে রেখে এসেছেন এবং সেসব অবৈধ অস্ত্র দিয়ে অনুগত বাহিনী পরিচালনা করে পাহাড়ে নিজের আধিপত্য বিস্তার অব্যাহত রেখেছেন (সন্তু লারমা একটি বেসরকারি টেলিভিশনে নিজেই বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন যে, তার অনুগতদের মধ্যে বেশ কয়েকশ’ অস্ত্রধারী পাহাড়ে আছে। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে তাকে কোনো জবাবদিহি না করা প্রশ্নের উদ্রেক করে। পাহাড়ের আরেকটি গোষ্ঠি যারা সন্তু লারমার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাহীন তারা যখন দেখলেন সন্তু লারমা একদিকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা পাচ্ছেন, অন্যদিকে অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে তাদের উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন তখন তারাও এর প্রতিরোধ করতে গড়ে তুললেন নতুন সন্ত্রাসী বাহিনী। এভাবেই এক সময় গড়ে উঠে ইউপিডিএফ নামক একটি ভয়ংকর গোষ্ঠি। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শুরু হয় উভয় গ্রæপের মধ্যে ভয়াবহ সংঘাত, ফলে প্রাণ হারায় উভয় পক্ষের অনেক মানুষ। কিছু দিন যেতে না যেতেই সন্তু লারমার দলে আবারো ভাঙন দেখা দেয়, জেএসএস ভেঙ্গে জেএসএস (সংস্কার) নামে আরো একটি গোষ্ঠি তৈরি হয়। সর্ব সম্প্রতি ইউপিডিএফ ভেঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দল। এই চারটি গোষ্ঠির আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ের কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে, ব্যাপক হারে চাঁদাবাজি হচ্ছে, খুনোখুনি হচ্ছে, রক্তপাত হচ্ছে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলো পাহাড়ি জনগণের মধ্যে নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে কিছু কিছু আদর্শের বুলি আউড়ায়, তাদের জন্য স্বাধীন জুম্ম ল্যান্ড প্রতিষ্ঠার স্বপ্নও দেখায়, যদিও তাদের মূল উদ্দেশ্য ক্ষমতা, অর্থ, প্রভাব প্রতিপত্তি। কিন্তু শান্তি চুক্তি একটি গোষ্ঠিকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাসহ ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা দিলেও অন্যান্য গোষ্ঠির জন্য তেমন সুফল বয়ে আনেনি। জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের নেতৃবৃন্দ দুই দশকের বেশি সময় ধরে আঞ্চলিক পরিষদে ক্ষমতাসীন থেকে আরাম-আয়েস করছেন, আর অন্যরা বনে জঙ্গলে মশা-মাছির কামড় খেয়ে অনিশ্চিত জীবন যাপন করছেন। এতে তাদের মধ্যে হতাশা দিন দিন বাড়ছে, ফলে মরিয়া হয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যেমন আক্রমণ চালাচ্ছেন, তেমনি প্রশাসনিক লোকজনসহ সাধারণ মানুষের উপরও আক্রমণ করছেন। স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি তাদেরকে বৈধ পথে ক্ষমতায়নের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সুযোগ দেওয়া যায় কিনা সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় জনগোষ্ঠিগুলোর ক্ষমতায়নের বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে আছে আঞ্চলিক পরিষদ (যদিও এটি সংবিধান পরিপন্থী বলে মত আছে উচ্চ আদালতের) এবং তিন জেলা পরিষদ। আঞ্চলিক পরিষদে বিনা চ্যালেঞ্জ এবং ন্যূনতম জবাবদিহিতা ছাড়াই ১৯৯৯ সালের ১২ মে থেকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় চেয়ারম্যান পদে আছেন জেএসএসের সভাপতি সন্তু লারমা। ২২ সদস্যের এ পরিষদের বেশিরভাগ সদস্যও তার দলের বা অনুগতদের মধ্য থেকেই নেওয়া হয়েছে। নির্বাচন না হওয়ায় ২০ বছরের বেশি সময় হয়ে গেলেও সেখানে অন্যদের আসার কোনো সুযোগ নেই। অন্যদিকে নির্বাচন না হওয়ার কারণে সময় সময় তিন জেলা পরিষদ পুনর্গঠিত হচ্ছে শুধু ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দিয়েই। ফলে অন্য কারো পক্ষে জেলা পরিষদ কিংবা আঞ্চলিক পরিষদে ক্ষমতাসীন হওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে। বিবদমান গোষ্ঠিগুলোর সামনে এটিও একটি বড় হতাশার কারণ। তাই পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি তিন পার্বত্য জেলায় নির্বাচনহীনতার সংস্কৃতি থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। তবে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের এই নির্বাচনহীনতার সংস্কৃতির পেছনে রয়েছে শান্তি চুক্তির একটি গোলক ধাঁধাঁ। যেখানে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় নির্বাচনগুলোর জন্য আলাদা একটি ভোটার তালিকা থাকবে। আর যারা পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা শুধু তাদের নিয়েই হবে এই ভোটার তালিকা। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে যাদের জায়গা-জমি আছে তারাই হবেন স্থায়ী বাসিন্দা। সমস্যা হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে জায়গা জমি নিয়ে বিরোধ আছে, তাই সেখানে জমির মালিকদের সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তাদের নিয়ে আলাদা ভোটার তালিকাও করা যাচ্ছে না। যার পরিণতিতে নির্বাচনও দেওয়া যাচ্ছে না। অপর দিকে, সরকার ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কমিশন করে দিলেও সন্তু লারমা তথা আঞ্চলিক পরিষদের পক্ষ থেকে অনাকাক্সিক্ষত দাবি-দাওয়ার কারণে সে কমিশন কাজ করতে পারছে না। আবার সন্তু লারমাদের দাবি পুরোপুরি সরকারের পক্ষ থেকেও মেনে নেওয়া সম্ভব না। কারণ সন্তু লারমাদের সকল দাবি মানতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির মালিকানা বাংলাদেশ সরকারের পরিবর্তে আঞ্চলিক পরিষদের কর্তৃত্বাধীন হয়ে যায়। বিষয়টি রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব এবং অখন্ডতার জন্য হুমকি স্বরূপ। এই গোলক ধাঁধাঁ থেকে বের হওয়ার রাস্তাটি যেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, ফলে পাহাড়ের নির্বাচনহীনতার সংস্কৃতিও বদলানো যাচ্ছে না। অথচ, আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক দলিল সংবিধান মতে, পাহাড়ের দ্বৈত ভোটার তালিকার পুরো ব্যাপারটিই অবৈধ। তাই এই অসাংবিধানিক একটি ইস্যুকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে দেশের একদশমাংশ এলাকাকে অশান্তির বেড়াজালে রেখে দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। এ ব্যাপারে গত ৮ এপ্রিল পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে করা সুপারিশের দিকেও সরকার নজর দিতে পারে।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং এর সন্নিহিত মিয়ানমার ও ভারতের পার্বত্যাঞ্চল নিয়ে একটি খ্রিস্টান বাফার স্ট্যাট গড়ার ব্রিটিশদের কল্পিত কুপ ল্যান্ড প্ল্যানের কারণে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গোষ্ঠির নজর বরাবরই এ অঞ্চলের প্রতি নিবদ্ধ ছিল যার প্রমাণ পাওয়া যায় এখানকার অধিকাংশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিগুলোকে খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করার মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে ভূ-কৌশলগত কারণে বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী হওয়ায় পরাশক্তিগুলোর কাছে দিনে দিনে পার্বত্য চট্টগ্রামের গুরুত্ব বেরেছে বহু গুণ। চীন, জাপান, আমেরিকা, ভারতসহ অনেক রাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরের দিকে গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আছে। কেউ কেউ এতদাঞ্চলে বিনিয়োগ করছে, কেউ কেউ এগিয়ে আসছে মানবিক সহায়তা নিয়ে। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত ১১ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিকের কক্সবাজারে উপস্থিতি তাদের সে সুযোগকে করেছে অবারিত। অন্যদিকে মিয়ানমার এবং ভারতের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ সীমান্ত দুর্গমতার কারণে এখনো অরক্ষিত। সে সুযোগে প্রতিবেশী দেশ দুটির বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলোর আনাগোনাও বাড়ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন এলাকাগুলোতে। সব মিলিয়ে পার্বত্য পরিস্থিতি ক্রমেই আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার গাইড লাইন তৈরি করতে হলে দেশি-বিদেশি শক্তিগুলোর কুদৃষ্টিসহ সম্ভাব্য সকল বিষয় বিবেচনায় নিয়েই সেটা তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের যেমন নির্মূল করতে হবে, তেমনি চুক্তি স্বাক্ষরকারী গোষ্ঠিটির দায়বদ্ধতার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে শান্তি চুক্তিতে থাকা দ্বৈত ভোটার তালিকার মতো অসাংবিধানিক ধারাগুলোর ব্যাপারে পুনর্মূল্যায়নও জরুরি।

দৈনিক ইনকিলাব

Print This Post Print This Post