বাংলাদেশের যে থানায় চার বছরে হয়নি কোন মামলা

আপডেট: ১ অক্টোবর ২০১৭ ১২:৪৮ অপরাহ্ন

1-23

অনলাইন ডেস্ক :
গত তিন চার বছরে ওই থানা এলাকায় কোনো চুরি ডাকাতি রাহাজানির মামলা হয়নি। কোনো লুটতরজের ঘটনাও না। কোনো গবাদি পশুও কারো খোয়া যায়নি। অনেকের কাছে ভাবতে অবাক লাগলেও এই দেশেই যখন রাত নেমে আসলে দরজার কপাট না আটকে কেউ ঘুমানোর কথা চিন্তাও করতে পারেন না সেখানে মাইলের পর মাইল বিস্তৃর্ণ জনপদের শতশত বাড়িঘরে কোনো দরজার অস্তিত্ব নেই, লাগেও না।

এ যে ক্ষুদ্র কোনো জনপদ তা কিন্তু নয়। প্রায় ৪০ হাজার জনসংখ্যা অধ্যুষিত পাহাড়ি উপজেলা রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলায় এ দৃশ্য বিরাজ করছে।
সরজমিন বিলাইছড়ির প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

কথা হচ্ছিলো বিলাইছড়ি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরের দুর্গম ধূপপানি পাহাড় চূড়ায় ভাগ্যধন তঞ্চঙ্গার মাচান ঘরে তার পুরো পরিবারের সাথেই। রাতও প্রায় গভীর। ঘরে কোনো দরজা রাখেননি? জানতে চাইতেই মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, লাগেনা।

ভাগ্যধন বলেন, তার জন্মের পর থেকে এই ৫৫ বছর বয়সে এই এলাকায় কোনো চুরি ডাকাতির কথা শোনেননি। এরকম কোনো বিচার সালিশও তাদের এলাকায় হয় না। তঞ্চঙ্গা ছাড়াও আশপাশের পাংখোয়া, চাকমা, মারমা গ্রামগুলোতেও একই চিত্র।

সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রাঙ্গমাটির পার্বত্য জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর শতশত পরিবার দরজাবিহীন খোলামেলা জীবন-যাপন করছেন, বাড়তি নিরাপত্তার কোনো বালাই নেই।

এমন কিছু পাড়ার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের জীবন ধারা দীর্ঘ যুগ যুগ ধরে এমন অবস্থায় চলে আসছে। আধুনিকতার ছোঁয়া, মোবাইল ফোন, সোলার সিস্টেম প্রত্যন্ত এলাকায় ঢুকে গেলেও সমতলের মতো আইনশৃঙ্খলা নিয়ে দুশ্চিন্তা এখনও জেঁকে বসেনি। চুরি-ডাকাতি এবং যানমালের নিরাপত্তার কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি এ পর্যন্ত।

বিলাইছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ মঞ্জুরুল আলম মোল্লা জানান, গত এক বছরেতো দূরের কথা গত তিন চার বছরেও বিলাইছড়ি থানায় চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি। এ বিষয়ে থানায় কোনো মামলাও হয়নি বলে তিনি জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, আমার থানায় কোনো চুরির মামলা নাই, ডাকাতির মামলা নাই।

এলাকাবাসী বলেন, আমরা শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও মানবিক দিক দিয়ে পিছিয়ে নেই। আমরা সামাজিক রীতি-নীতি মেনে চলি, মেনে চলি স্থানীয় গণ্যমান্যদের কথা ও আদেশ-উপদেশ।

সরজমিন ঘুরে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা জুমচাষে যেসব উৎপাদিত পণ্য বা খাদ্যশস্য উৎপাদন করেন সেসব পণ্যসামগ্রী জুমে (বসতবাড়ি থেকে বহুদূরে) খোলা অবস্থায় মাসকে মাস ধরে ফেলে রাখেন। একটু কাজের অবসর পেলেই তখন তারা জুম থেকে ওইসব খাদ্যশস্য বসতবাড়িতে নিয়ে আসেন। তাতে কোনদিন কোনো সম্পদ চুরি হয় না। না চেয়ে কারো জিনিস কেউ ধরে না। যার কারণে যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাদের জীবন ধারা এমনভাবে চলে আসছে।

এ বিষয়ে বিলাইছড়ি উপজেলার ৩নং ফারুয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিদ্যালাল তঞ্চঙ্গ্যার সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, ফারুয়া ইউনিয়নের অনেক পাড়ায় সে রকম দরজাবিহীন বসতবাড়ি রয়েছে। বিশেষ করে সেই প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে যেমন মন্দিরছড়া, সাবাতলীসহ আরও অনেক গ্রাম রয়েছে।

যাদের বাড়িগুলো মাচাংঘর। ঘরগুলোতে কোনো দরজা নেই। আর প্রায় প্রত্যেক পাড়ায় এমন দরজাবিহীন বসতবাড়ি রয়েছে। অনেক পাড়াতে এর পরিসংখ্যান একটু বেশি আর সদরের স্বচ্ছল গ্রামগুলোতে এর পরিসংখ্যান একটু কম বলে তিনি জানান।

তিনি আরও বলেন, আমার ইউনিয়নে এ পর্যন্ত কারো ঘরে চুরি-ডাকাতির কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। তবে অন্তত বিগত এক বছরের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটেনি বলে নিশ্চিত করেন তিনি।

১নং বিলাইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি দেওয়ান বলেন, আমার ইউনিয়নের অনেক পাড়ায় এমন নিরাপত্তাহীন পরিবার আছে। তাদের কাঠের কোনো মজবুত দরজা নেই। তবে বাড়িতে প্রাণি প্রবেশ না করতে পারার জন্য বাঁশ দিয়ে নামে মাত্র দরজা তৈরি করে একটি বাঁশ দ্বারা আঁটকিয়ে দেন। তবে তা ঘরে না। চুরি-ডাকাতির কোনো ঘটনা এ পর্যন্ত ঘটেছে বলে অভিযোগ আসেনি।

৪ নম্বর বড়থলি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ার‌ম্যান আতোমং মারমা জানান, তার ইউনিয়নে তঞ্চঙ্গ্যা, মারমা, ত্রিপুরা ও মুরং ইত্যাদি সম্প্রদায় রয়েছে। যাদের অধিকাংশ জনগণের বসতবাড়িতে দরজা নেই। তবে সেখানে চুরি-ডাকাতির কোনো ঘটনা ঘটতে শোনা যায় নাই বলে তিনি জানান।

উপজেলা চেয়ারম্যান শুভমঙ্গল চাকমা বলেন, উপজেলায় চুরি অথবা ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে বলে আজ পর্যন্ত কেউ অভিযোগ নিয়ে আসেন নাই বা বিগত এক বছরেও এমন ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায় নাই।

ওসি মঞ্জুরুল আলম আরও বলেন, পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও সম্প্রীতি এর বড় কারণ। এখানকার সব মানুষ শ্রম আর খেটে খাওয়াকেই তাদের অবলম্বন মনে করে। অন্যের সম্পদে নজর দেওয়াটা তারা চিন্তায়ও আনে না।

Print This Post Print This Post